জনতার কলামঃশিশু-কিশোররাই দেশ ও জাতির ভবিষ্যত কর্ণধার। তাদের উন্নতি ও অগ্রগতির উপর নির্ভর করে দেশ ও জাতির উন্নতি।
শিশু-কিশোরদের সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশের ক্ষেত্রে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের ভূমিকা অপরিসীম। তাদের একটি অংশ কোন কারণে অপরাধের সাথে যুক্ত হয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য চরম হুমকি ও সুস্থ সমাজ জীবনের প্রতিবন্ধক হোক তা কারো কাম্য নয়।
এজন্যই ইসলাম শিশু-কিশোরদের সুস্থ, স্বাভাবিক ও সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে এবং অপরাধমুক্ত জীবন-যাপনের উপস্থাপন করেছে সর্বজননীন ও কল্যাণকর নীতিমালা। যা বাস্তবে কার্যকর করতে পারলে পরিবার পেতে পারে কাক্সিক্ষত প্রশান্তি এবং দেশ ও জাতি লাভ করতে পারে অমূল্য সম্পদ।
কিশোর অপরাধ প্রত্যয়টির ইংরেজী হলো ঔাঁবহরষব উবষরহয়ঁবহপু। আর উবষরহয়ঁবহপু ল্যাটিন শব্দ উবষরহয়ঁবৎ থেকে উদ্ভূত। যার অর্থ ঃ ঃড় ড়সরঃ বাদ দেয়া, বর্জন করা, উপেক্ষা করা ইত্যাদি। রোমানরা কোন ব্যক্তির উপর আরোপিত কর্ম অথবা কর্তব্য পালনে ব্যর্থতা বুঝাতে উবষরহয়ঁবহপু শব্দটি ব্যবহার করত। ১৪৮৪ সালে উইলিয়াম কক্সসন সর্বপ্রথম উবষরহয়ঁবহঃ পরিভাষাটিকে দোষী ব্যক্তির প্রচলিত অপরাধ বর্ণনার ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছিলেন। এছাড়াও ১৬০৫ সালে ইংরেজ কবি সেক্সপিয়ারের বিখ্যাত নাটক “গধপনবঃয” এ শব্দটির ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়।
কিশোর অপরাধ পরিভাষা আলোচনার পূর্বে শব্দ দু’টিকে পৃথকভাবে বিশ্লেষণ করলে এর প্রতিপাদ্য বিষয় সহজেই অনুমেয় হবে। সাধারণত কিশোর বলতে অপ্রাপ্ত বয়স্ক তথা বাল্য ও যৌবনের মধ্যবর্তী বয়সের ছেলে-মেয়েদের বুঝায়। তবে কৈশোর কালের সীমা নির্ধারণের ক্ষেত্রে প্রচলিত আইন ও ইসলামী আইনে কিছুটা ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। প্রচলিত আইনে দেশ ও সমাজভেদে নির্দিষ্ট বয়সের ছেলে মেয়েরা কিশোর-কিশোরী হিসেবে বিবেচিত। যেমন বাংলাদেশে কিশোর অপরাধীর বয়স সীমা হলো ৭ থেকে ১৬ বছর পর্যন্ত। এছাড়া পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রচলিত কিশোর অপরাধীর বয়সসীমা নিচের সারণীতে তুলে ধরা হলো: মায়ানমার ৭ থেকে ১৬ বছর পর্যন্ত, শ্রীলংকা ৭ থেকে ১৬ বছর পর্যন্ত, ভারত ৭ থেকে ১৬ বছর পর্যন্ত, পাকিস্তান ৭ থেকে ১৫ বছর পর্যন্ত, ফিলিপাইন ৯ থেকে ১৬ বছর পর্যন্ত, থাইল্যান্ড ৭ থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত, জাপান ১৪ থেকে ২০ বছর পর্যন্ত, ইংল্যান্ড ৮ থেকে ১৭ বছর পর্যন্ত, ফ্রান্স ১৩ থেকে ১৬ বছর পর্যন্ত, পোল্যান ্ড ১৩ াথেকে ১৬ বছর পর্যন্ত, অস্ট্রিয়া ১৪ থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত, জার্মানী ১৪ থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত।
মহান আল্লাহ মানুষকে বিভিন্ন স্তরে সৃষ্টি করেছেন। তাঁর অসীম রহমতে মানব সন্তান শৈশব, কৈশোর, যৌবন ও প্রৌঢ়কাল পেরিয়ে বার্ধক্যে উপনীত হয়। এ প্রসঙ্গে আল কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তা’আলা বলেন, “আমি তোমাদেরকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছি। এরপর বীর্য থেকে, এরপর জমাট রক্ত থেকে, পূর্ণাকৃতিবিশিষ্ট ও অপূর্ণাকৃতিবিশিষ্ট মাংসপিন্ড থেকে, তোমাদের কাছে ব্যক্ত করার জন্য। আর আমি এক নির্দিষ্ট কালের জন্য মাতৃগর্ভে যা ইচ্ছা রেখে দেই, এরপর আমি তোমাদেরকে শিশু অবস্থায় বের করি; তারপর তোমরা যেন যৌবনে পদার্পণ কর। তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ মৃত্যুমুখে পতিত হয় এবং তোমাদের মধ্যে কাউকে নিষ্কর্মা বয়স পর্যন্ত পৌঁছানো হয়, সে যেন জানার পর জ্ঞাত বিষয় সম্পর্কে স্বজ্ঞান থাকে না। “আল-কুরআন, ২২; ৫”।
মানব জীবনের বিবর্তিত স্তরগুলোকে আরবী অভিধানে বিভিন্ন নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। ইসলামী আইনবিদগণ কিশোর বলতে ঐ ছেলেদের বুঝিয়েছেন যাদের ইহতিলাম”। বা স্বপ্নদোষ শুরু হয়নি এবং কিশোরী বলতে যাদের হায়েয। বা মাসিক ঋতুস্রাব হয়নি এমন মেয়েদেরকেই বুঝিয়েছেন। ইসলাম কৈশোর কালেল সীমা নির্ধারণের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট বয়সের উল্লেখ না করে বিশ্বজনীন ও বাস্তবসম্মত নীতি হিসেবে বয়ঃপ্রাপ্তিকে চুড়ান্ত সীমা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বালিগ বা বয়ঃপ্রাপ্তির লক্ষণ হিসেবে ছেলে-মেয়েদের মধ্যে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো সুস্পষ্টভাবে প্রকাশিত হলে তারা কিশোর-কিশোরী হিসেবে বিবেচিত হবে না; বরং বয়ঃপ্রাপ্ত বলে গণ্য হবে। ছেলে ও মেয়েদের বয়ঃপ্রাপ্তির লক্ষণগুলো হলো ঘুমন্ত বা জাগ্রত অবস্থায় ইহতিলাম বা বীর্যপাত হওয়া। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেন, “তোমাদের সন্তানেরা স্বপ্নদোষ হওয়ার পর্যায়ে পৌঁছলে অর্থাৎ বয়ঃপ্রাপ্ত হলে তারাও যেন অনুমতি প্রার্থনা করে যেমন অনুমতি প্রার্থনা করে থাকে তাদের বয়োজ্যেষ্ঠগণ। “আল-কুরআন, ২৪ : ৫৯”। এছাড়াও মেয়েদের হায়েয বা মাসিক ঋতুস্রাব ও গর্ভবর্তী হওয়ার মাধ্যমে বয়ঃপ্রাপ্তি প্রমাণিত হতে পারে।
উপর্যুক্ত লক্ষণগুলোর কোনটিই যদি কারো মধ্যে প্রকাশিত না হয়, সে ক্ষেত্রে বয়স নির্ধারণের মাধ্যমে বালিগ বা বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়ার বিষয়টি সাব্যস্ত করা যায়। তবে ইসলামী আইনবিদগণ কিশোর-কিশোরীর বয়সের চূড়ান্ত সীমা নির্ধারণের ব্যাপারে বিভিন্ন মতামত ব্যক্ত করেছেন। ইমাম আবু হানীফা রহ. ও মালিকী আইনবিদদের মতানুযায়ী, যে ছেলের ইহতিলাম বা বীর্যপাত হয়নি, তার আঠার বছর পূর্ণ বা হওয়া পর্যন্ত সে কিশোর হিসেবে বিবেচিত হবে। আর যে মেয়ের ইহতিলাম বা বীর্যপাত হয়নি, তার সতের বছর পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত তাকে কিশোরী বলে গণ্য করা হবে।
অন্যদিকে কোন ছেলে-মেয়ের মধ্যে বয়ঃপ্রাপ্ত কোন লক্ষণ যদি আদৌ প্রকাশ না পায়, তাহলে পনের বছর বয়সে উপনীত না হওয়া পর্যন্ত তারা উভয়ই কিশোর-কিশোরী হিসেবে বিবেচিত হবে বলে ইমাম শাফি’ঈ, ইমাম আহমাদ, হানাফী আইনবিদ ইমাম মুহাম্মাদ ও আবু ইউসুফ রহ. সহ অধিকাংশ আইনবিদ অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
অপরাধের আরবী আল-জারীমাহ।
আল-জারীমাহ শব্দটি একবচন, বহুবচনে আল-জারাইম, যা আল-জুরম থেকে উদ্ভুত। আল-জুরমু শব্দটির জীম অক্ষরে পেশ যোগে অর্থ পাপ, সীমালংঘন ইত্যাদি। ইসলামী আইনের পরিভাষায় অপরাধ বলতে শরী’আতের এমন আদেশ-নিষেধের লঙ্ঘনকে বুঝায়, যা করলে হদ্দ অথবা তা’যীর প্রযোজ্য হয়।
কিশোর অপরাধ প্রত্যয়টির সংজ্ঞায়নে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পরিলক্ষিত হয়। সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে কিশোর বয়সে অবাঞ্ছিত ও সমাজ বিরোধী আচরণ সম্পাদন করাকেই বলা হয় কিশোর অপরাধ।
মার্কিন অপরাধ বিজ্ঞানী বলেন, সমাজ কর্তৃক আকাক্সিক্ষত আচরণ প্রদর্শনে কিশোরদের ব্যর্থতাই কিশোর অপরাধ। আইনগত দিক থেকে কিশোর অপরাধ বলতে অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে-মেয়ে কর্তৃক আইন বিরুদ্ধ দণ্ডনীয় কর্ম সম্পাদন করাকেই বুঝায়।
Discussion about this post