টাঙ্গাইল ব্যুরোঃকরটিয়ার জমিদার টাঙ্গাইল জেলার একটি প্রাচীন জমিদার পরিবার। এ জমিদারির পন্নী পরিবারের সাদত আলী খান পন্নী ইংরেজী সতেরো শতকের প্রথম দিকে করটিয়াতে বসবাস শুরু করলে তারা করটিয়ার জমিদার হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

তাদের মাথার মুকুট ছিল প্রজারাই। মজলুম জননেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ
খান ভাসানী বলেছিলেন, ‘করটিয়ার জমিদারদের মত যদি সব জমিদাররা হতো তবে জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ করার প্রয়োজন হতো না।’
করটিয়া তথা টাঙ্গাইলবাসী হতে জানা যায়, আমরা আমাদের চির অভিভাবক দানবীর ঐতিহ্যবাহী পন্নী জমিদারদের কাছে চিরঋণী। তাদের তুলনা শুধু তারাই ছিলেন। সৃষ্টিকর্তা তাদের সৃষ্টিই করেছিলেন প্রজাদের মাঝে প্রতিভা, প্রচেষ্টা, পথপ্রদর্শক ও অর্থ সঠিকভাবে প্রয়োগ করে ভবিষ্যৎ সফল করতে।
উনিশ শতকের প্রথম দিকে সা’দত আলী খান পন্নী সম্পত্তির মালিকানা নিয়ে নানা মামলায় জড়িয়ে পড়েন। ঢাকার জমিদার খাজা আলীমুল্লাহর সহায়তায় তিনি পৈত্রিক সম্পত্তি উদ্ধার করেন, কিন্তু শর্ত ভঙ্গের কারণে পাল্টা মামলা করে খাজা আলিমুল্লাহ ভোগ-স্বত্বের ডিক্রি লাভ করেন। তখন সা’দত আলী খান সম্পত্তি রক্ষার জন্য স্ত্রী জমরুদুন্নেসা খানমের নামে তা দানপত্র করে দেন। পরে অবশ্য উভয় পক্ষের মধ্যে আপোষ মীমাংসা হয়। সাদত আলী খান সম্পত্তির ৭ আনা অংশ খাজা আলিমুল্লাহকে ছেড়ে দেন। অতঃপর বাংলা ১২২৭ সনের ৯ পৌষ সা’দত আলী খান এবং তাঁর স্ত্রী জমরুদুন্নেসা খানম যৌথভাবে একটি দলিল করেন। এতে সমস্ত সম্পত্তি দুটি ভাগে বিভক্ত করে এক ভাগ পরিবারের ব্যয় ও অন্য ভাগ ওয়াকফ্ করে ধর্মীয় ও দাতব্য কাজে ব্যয় করার জন্য নির্দিষ্ট করা হয়। ওয়াকফ্ সম্পত্তি দেখাশুনা করার জন্য তখন মুতাওয়াল্লী নিয়োগের বিধান রাখা হয়।
জানা যায়, সা’দত আলী খান পন্নীর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র হাফেজ মাহমুদ আলী খান পন্নী মুতাওয়াল্লী ছিলেন। মাহমুদ আলী খান পন্নীর মৃত্যুর (১৮৯৬) পর মুতাওয়াল্লী কে হবেন এ নিয়ে তাঁর পুত্র ওয়াজেদ আলী খান পন্নী (চাঁদ মিয়া) এবং পিতামহী জমরুদুন্নেসা খানমের মধ্যে বিবাদ ও মামলা মোকদ্দমা সংঘটিত হয়েছে।
পরিশেষে ওয়াজেদ আলী খান পন্নী জয়ী হন এবং
দক্ষতার সঙ্গে জমিদারি পরিচালনা করেন।
ওয়াজেদ আলী খান পন্নী (চাঁদ মিয়া) ছিলেন করটিয়া জমিদারকুলের সবচেয়ে স্বনামধন্য। তিনি জমিদারি সম্প্রসারণসহ প্রজাদের সকল সুযোগ-সুবিধা প্রদানে মনোনিবেশ করেন। তিনি ১৯০১ সালে করটিয়াতে হাফেজ মাহমুদ আলী ইনস্টিটিউশনটি স্থাপন করেন। তাঁর উদ্যোগে ১৯০৬ সালে করটিয়াতে নিখিল বাংলা মুসলিম শিক্ষা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহ।
১৯১০ সালে চাঁদমিয়া করটিয়াতে আয়োজন করেন মুসলিম এডুকেশন কনফারেন্স। তিনি ময়মনসিংহ জেলা কংগ্রেস এবং বঙ্গীয় প্রাদেশিক কমিটির সহ সভাপতি ছিলেন। ব্রিটিশ সরকারের কতিপয় অন্যায় ব্যবস্থার প্রতিবাদ করে ১৯২১ সালে তিনি কারাবরণ করেন। ওয়াজেদ আলী খান পন্নী কর্তৃক করটিয়ায় প্রতিষ্ঠিত সা’দত কলেজ (১৯২৬) পূর্ব বাংলায় মুসলমান কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত একটি অনন্য কলেজ।
একই বছর তিনি রোকেয়া হাই মাদ্রাসা স্থাপন করেন। তিনি ১৯২৬ সালে জনহিতকর কাজের জন্য বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি ওয়াকফ করে দেন। এ ওয়াকফ দলিলে সকল খরচ বাদে বার্ষিক নিট আয় ধরা হয় তৎকালীন আশি হাজার টাকা। এ অর্থ থেকে বিশ হাজার টাকা নিজ পরিবারের ভরণপোষণের জন্য রেখে বাকি টাকা স্কুল, কলেজ, চিকিৎসালয়, মসজিদ সহ জনহিতকর কাজে সহায়তার জন্য দান করা হয়। ১৯৩৬ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
নির্ভরযোগ্য সুত্র জানাযায়, ওয়াজেদ আলী খানের পিতা হাফেজ মাহমুদ আলী খান পন্নীর অর্থানুকুল্যে ও পৃষ্ঠপোষকতায় মুন্সি নইমুদ্দীনের সম্পাদনায় করটিয়া থেকে ১৮৮৪ সালে আখবারে ইসলামীয়া পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশিত হতো। করটিয়া জমিদার বাড়ির প্রেস হতে রসিক লাল বসু রচিত আতিয়ার ইতিহাস, ফতোয়ায়ে আলমগিরী (অনুবাদ), মওলানা নঈম উদ্দিনের জুবদাতুল মাসায়েল প্রভৃতি পুস্তক প্রকাশিত হয়। হাফেজ মাহমুদ আলী খান পন্নী করটিয়ায় স্থাপন করেন মাহমুদীয়া মাদ্রাসা ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়।
ওয়াজেদ আলী খানের দৌহিত্র খুররম খান পন্নী পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের চীপ হুইপ এবং একজন রাষ্ট্রদূত ছিলেন।
অপরদিকে দৌহিত্র হুমায়ন খান পন্নী বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পীকার ছিলেন। খুররম খান পন্নীর পুত্র ওয়াজেদ আলী খান পন্নী (দ্বিতীয়) বাংলাদেশ সরকারের উপমন্ত্রী ছিলেন।
করটিয়া জমিদার বাড়ির লোহার ঘর, রোকেয়া মহল, দাউদ মহল ঐতিহাসিক সাক্ষী হিসেবে টিকে রয়েছে ।