টাঙ্গাইল ব্যুরোঃ টাঙ্গাইলের নাগরপুরের কৃষকরা অল্প সময়ে অধিক অর্থ লাভের আশায় স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে তামাক চাষ করছে। নানা প্রণোদনায় কৃষকরা কয়েক বছর ধরে তামাকের পরিবর্তে ভুট্টা চাষে আগ্রহী হলেও এবার বিষবৃক্ষ নামক তামাকের চাষ ছড়িয়ে পড়েছে। বিভিন্ন টোব্যাকো কোম্পানির প্রলোভনে পড়ে অধিক লাভের আশায় কৃষকরা তামাক চাষের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। তামাক চাষে ‘কারগিল’ নামক সার প্রয়োগের ফলে চাষি ও তার পরিবারের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে, ফসলি জমির উর্বরাশক্তি কমে যাচ্ছে।
সরেজমিন দেখা যায় নাগরপুরের ১২টি ইউনিয়নের মধ্যে চরাঞ্চলে ব্যাপকহারে তামাক চাষ হচ্ছে। ধলেশ্বরী, লৌহজং নদীর তীরঘেঁষা এসব চরাঞ্চলে প্রতিবছরই বর্ষাকালে পলি পড়ে। ফলে এসব এলাকার জমি উর্বর হয়ে থাকে। জমিগুলো বালি ও দো’আশ মাটি হওয়ায় এক সময় মশুর, মাস কলাই, ভুট্টা, চিনা, কাউন, গম, আলু, আখ, বাদাম ইত্যাদি ফসল বেশি পরিমাণে উৎপাদন হতো। স্থানীয় কৃষকরা বহুজাতিক ও দেশীয় টোব্যাকো কোম্পানির প্রলোভনে পড়ে ওইসব ফসল চাষ না করে বেশি লাভের আশায় ‘বিষবৃক্ষ’ তামাক চাষের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠছে।
বাংলাদেশে তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণ ও উৎপাদন বন্ধ করে সরকার বিকল্প কৃষিজ উৎপাদনে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করায় কৃষি বিভাগের কর্মকর্তাদের তৎপরতায় ২০১১ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত জেলায় তামাক চাষ অনেকটাই কমে গিয়েছিল। কিন্তু এ বছর টোব্যাকো কোম্পানির প্রতিনিধিরা কৃষকদের অধিক মুনাফার পাশাপাশি সার, বীজ ও সেচের জন্য নগদ টাকা (ঋণ) হিসেবে দেয়ায় আবার তামাক চাষের পরিমাণ কয়েকগুণ বেড়েছে।
জানা গেছে, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো, ঢাকা টোব্যাকো, জাপান টোব্যাকো, আবুল খায়ের টোব্যাকো, বিভিন্ন বিড়ি, সিগারেট ও জর্দা কোম্পানি সহ আরো কিছু কোম্পানি তাদের প্রতিনিধির মাধ্যমে স্থানীয় কৃষকদের তামাক চাষে উৎবদ্ধ করছে। সরকারি কোনরূপ নিষেধাজ্ঞা না থাকার ফলে কৃষকদের এ চাষে উৎসাহ জোগাচ্ছে টোব্যাকো কোম্পানিগুলো।
তামাক চাষে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো অগ্রীম টাকা, বীজ ও সার প্রদান এবং বিভিন্নভাবে তামাক চাষে সাহায্য-সহযোগিতা করছে। সরকার যখন চেষ্টা করছে তামাক চাষের পরিবর্তে অন্য ফসল চাষে কৃষকদের উৎসাহী করতে তখনই লক্ষ্য করা যাচ্ছে টোব্যাকো কোম্পানির অপতৎপরতায় তামাক চাষ ধীরে ধীরে বাড়ছে।
নাগরপুরের ধল্ল্যা, পাকুটিয়া, ভাদ্রা, বেকরা, আটগ্রাম, সলিমাবাদ, ধুবুরিয়া, মোকনা, বনগ্রাম, শাহজানী প্রভৃতি অঞ্চলে তামাক চাষ হচ্ছে।
তামাক চাষে জড়িত চাষি ও তাদের পরিবারের অভিযোগ, তামাক চাষের ক্ষতিকর দিক উল্লেখ বা এ চাষ বন্ধে কৃষি কর্মকর্তাদের কোনরূপ পদক্ষেপ না থাকায় দিনদিন এর ব্যাপকতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাদের মতে, প্রতি শতাংশ জমি বাবদ পাঁচ কেজি সার ও পরিমাণমত তামাক বীজ সরবরাহ করছে টোব্যাকো কোম্পানি। তামাক চাষে শতাংশ প্রতি প্রায় এক হাজার টাকার তামাক উৎপাদন করা যায়। মাটির উবর্রতা শক্তি নষ্ট হওয়া সত্ত্বেও কম পরিশ্রমে তামাক অধিক লাভজনক হওয়ায় কৃষকরা এ চাষে উৎবদ্ধ হচ্ছে। কারগিল সার বা অতিরিক্ত সার ব্যবহারের ফলে কৃষি জমিগুলো নষ্ট হওয়ার কথাও স্বীকার করেছেন চাষিরা। কিন্তু লাভ বেশি হচ্ছে পাশাপাশি এ কথাও বলছেন।
কৃষক পরিবারগুলো জানায়, তামাক শুকানোসহ ঘরে মজুদ করে রাখতে তাদের শারীরিক নানা সমস্যা হচ্ছে। বাড়ির অনেকেরই চর্ম, শ্বাসকষ্ট, হাঁপানী ইত্যাদি রোগ দেখা দিচ্ছে। তারা অভিযোগ করে বলেন, কোম্পানিগুলো তামাক চাষ বৃদ্ধিতে বীজ ও সার সরবরাহ করলেও স্বাস্থ্য সচেতনতায় গায়ে অ্যাপ্রোণ বা মাস্ক সরবরাহ করে না। এতে তাদের হাতে চর্মরোগ ও শ্বাসকষ্ট দেখা দিচ্ছে। তামাক শুকিয়ে কোম্পানিকে বুঝিয়ে দিলে লাভটা ঘরে থাকে।
তিনি জানান, এই একই জমিতে কলাই, বাদাম, চিনা ইত্যাদি চাষ করলে নিজেদের পুঁজি লগ্নি করতে হয়। শ্রমিক লাগে একা সব কাজ করা যায় না। তাছাড়া লাভ থাকে তামাকের তুলনায় অর্ধেক বা তারও কম। প্রায় একই কথা বলেন, স্থানীয় মজনু মিয়া, জমির উদ্দিন ও কিতাব আলী। নাগরপুরের আজিজুল, মফিদুল, রূপচান। তাদের সবার বক্তব্যই প্রায় একই। তাই বোঝালে কী হবে?