বিশেষ প্রতিনিধিঃস্বামীর বিরুদ্ধে থানায় মামলা করতে গিয়েছিলেন কলেজছাত্রী লিজা রহমান (২০)। কিন্তু পুলিশ মামলা না নেয়ার কারণেই থানা থেকে বেরিয়ে তিনি গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। মৃত্যুর আগে নিজের জবানবন্দিতে লিজা এ কথায় জানিয়ে গিয়েছেন।
বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের পরিচালক (অভিযোগ ও তদন্ত) আল-মাহমুদ ফয়জুল কবির বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
গত ২৮ সেপ্টেম্বর রাজশাহী মহানগরীর শাহমখদুম থানার বাইরে নিজের শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন দেন লিজা। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন লিজা মা’রা যান। তার মৃ’ত্যুর কারণ নিয়ে তদন্ত করছে বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন। চার সদস্যের এই তদন্ত কমিটি গত ২ অক্টোবর রাজশাহীতে এসে প্রথম দফায় তদন্ত করে।
পরে বৃহস্পতিবার তদন্ত কমিটির সদস্যরা আবার রাজশাহী এসে শাহমখদুম থানার দুজন পুলিশ সদস্য, পুলিশের ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের চারজন, ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী চারজন, লিজার কলেজের অধ্যক্ষসহ সংশ্লিষ্ট আরও কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেন।
শুক্রবার সকালে তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক আল-মাহমুদ ফয়জুল কবির রাজশাহীর একটি রেস্ট হাউসে সাংবাদিকদের সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলেন।
তিনি জানান, লিজা রহমান ডাইং ডিক্লিয়ারেন্সে বলেছে, তার মামলা না নেয়ার ব্যাপারে পুলিশ নারাজি ছিল। সে জন্যই সে এই পথ বেছে নিয়েছে। এ রকম ডাইং ডিক্লিয়ারেন্সে বলা আছে।’
পুলিশের তদন্ত অবশ্য সে কথা বলছে না। লিজার গায়ে আগুন দেয়ার পর রাজশাহী মহানগর পুলিশের (আরএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার সালমা বেগমকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তাদের দেয়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ ব্যাপারে পুলিশের কোনো গাফিলতি নেই।
আর মানবাধিকার কমিশনের পরিচালক আল-মাহমুদ ফয়জুল কবির বলছেন, গড়মিল রয়েছে পুলিশের দেয়া তথ্যে।
তিনি বলেন, শাহমখদুম থানার পুলিশের এবং ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের পুলিশের সরবরাহকৃত তথ্য-উপাত্ত যেমন- ভিডিও ফুটেজ, এজাহার, জিডির কপি এবং তাদের সাক্ষীর মধ্যে গড়মিল পরিলক্ষিত হয়েছে।
কোন বিষয়ে গড়মিল দেখা যাচ্ছে, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, লিজার দায়ের করা যে জিডিটা দেখানো হচ্ছে, সেখানে লিজার স্বামী এবং শ্বশুরের নাম-ঠিকানা লেখা আছে।
কিন্তু থানা এবং ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা বলেছেন, ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার থেকে লিজা সর্বশেষ বের হয়ে যায় স্বামী এবং শ্বশুর-শাশুড়ির নাম-ঠিকানা সংগ্রহের কথা বলে। অথচ জিডিতেই সেটা উল্লেখ আছে।
তবে এ সময় আর বিস্তারিত কিছু জানাতে রাজি হননি মানবাধিকার কমিশনের তদন্ত কমিটির এই প্রধান।
তিনি বলেছেন, রোববার কমিশনে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়া হবে। তখনই পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শাহ মাখদুম থানার ওসি মাসুদ পারভেজ বলেন, লিজার অভিযোগ শোনা হয়েছিল। তার অভিযোগ মামলা আকারে রেকর্ডের নির্দেশও দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সে হঠাৎ করেই থানা থেকে বের হয়ে গায়ে আগুন লাগিয়ে দেয়। লিজাকে নিয়ে পুলিশের কোনো গাফিলতি নেই বলে দাবি করেন তিনি।
লিজা গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার প্রধানপাড়া এলাকার আবদুল লতিফ বিশ্বাসের পালিত মেয়ে। তিনি রাজশাহী মহিলা কলেজের বাণিজ্য দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী ছিলেন। নগরীর পবাপাড়া এলাকার একটি মেসে থাকতেন।
তার স্বামী সাখাওয়াত হোসেন (২০) চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলার খানদুরা গ্রামের খোকন আলীর ছেলে। সাখাওয়াত রাজশাহী সিটি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র। সাখাওয়াতও রাজশাহীতে একটি ছাত্রাবাসে থাকতেন। পরিবারকে না জানিয়েই লিজাকে বিয়ে করেন সাখাওয়াত।
জানা গেছে, লিজার পালিত বাবা রাজনৈতিক মামলায় সে সময় কারাগারে ছিলেন। এ অবস্থায় তার টাকা-পয়সার সংকটও চলছিল অনেকদিন ধরে। লেখাপড়া বন্ধের উপক্রম হয়েছিল। অন্যদিকে স্বামীও তার দায়িত্ব নিতে চাইছিল না। ফলে দুজনের দেখা হলেই ঝ’গড়া হতো।
সম্প্রতি স্বামী তাকে নির্যাতন করেন। এ কারণে থানায় অভিযোগ করতে গিয়েছিলেন লিজা। সেখানে ডিউটি অফিসারকে তার অভিযোগ রেকর্ড করার জন্য অনেকবার অনুরোধ করেন। ডিউটি অফিসার তা না করায় ওসির সঙ্গেও দেখা করেন লিজা।
কিন্তু ওসি তাকে পাত্তা না দিয়ে থানা চত্বরেই পুলিশের ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে গিয়ে অভিযোগ দিতে বলেন। পরে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে যান লিজা। সেখানেও কেউ তাকে পাত্তা দেয়নি। ফলে লিজা সেখান থেকেও বের হয়ে যান। এরপর থানা থেকে প্রায় ১০০ গজ দূরে মহিলা কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের গেটের সামনে গায়ে কে’রোসিন ঢেলে আ’গুন দেন লিজা।
তখন আশেপাশের লোকজন তাকে উদ্ধার করে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। তবে লিজার শ্বাসনালীসহ শরীরের প্রায় ৬৪ অংশ পুড়ে যাওয়ায় তাকে ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়। সেখানে তার মৃত্যু হয়।
এ ঘটনায় আত্মহত্যার প্ররোচনার অভিযোগে লিজার স্বামী সাখাওয়াত হোসেন, শ্বশুর মাহবুবুল হক খোকন ও শাশুড়ি নাজনীন আক্তারের বিরুদ্ধে একটি মা’মলা হয়েছে। লিজার বাবা মো. আলম বাদী হয়ে শাহমখদুম থানাতেই মামলাটি দায়ের করেছেন। আসামিদের পুলিশ গ্রেফতার করেছে।