পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ওষুধ ও রসায়ন খাতের কোম্পানি গ্লাক্সোস্মিথক্লাইন বাংলাদেশে ওষুধের ব্যবসায় গুটিয়ে নেওয়াকে ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছেন প্রতিষ্ঠানের কর্মরত শ্রমিক-কর্মচারিরা।
বুধবার চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে গ্লাক্সোস্মিথক্লাইন এমপ্লয়িজ ইউনিয়নের নেতারা দ্রুত কারখানা খুলে দেয়ার দাবিও জানান।
লিখিত বক্তব্যে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মো. আজম বলেন, একটি লাভজনক শিল্প প্রতিষ্ঠানকে বন্ধ করে বাংলাদেশ থেকে তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়ার জন্য দেশি-বিদেশি নানা স্বার্থান্বেষী মহল তৎপর।
আমাদের ধারণা বিদেশি ব্যবস্থাপনা পরিচালক এই চক্রান্তের সাথে সরাসরি জড়িত।
এজন্য প্রতিষ্ঠানের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক পাকিস্তানি নাগরিক ইরাম শাকীর দিকে সন্দেহের তীর ছুঁড়েছেন প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক-কর্মচারিরা।
আজম বলেন, এ পাকিস্তানি নাগরিক প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশ থেকে সরিয়ে নেওয়ার সকল তৎপরতা চালিয়েছেন।
বর্তমানে ইন্দোনেশিয়ায় কর্মরত ইরাম শাকী গত দুই বছর ধরে কিছু বাংলাদেশিকে সাথে নিয়ে নেগেটিভ রিপোর্ট দিয়েছেন।
গ্লাক্সোস্মিথক্লাইন লাভজনক প্রতিষ্ঠান দাবি করে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ২০১৩ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে প্রতিষ্ঠানের নীট মুনাফা ৩৫১ কোটি ৭৯ লাখ ৬৪ হাজার টাকা। সরকারি রাজস্ব খাতে জমা দিয়েছে এক হাজার কোটি টাকা।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক কোম্পানি গ্ল্যাক্সোস্মিথক্লাইন ১৯৭৪ সাল থেকে চট্টগ্রামের ফৌজদারহাটের কারখানায় উৎপাদন চালিয়ে আসছিল । সেখানে উৎপাদিত ভ্যাকসিন ইউনিসেফের মাধ্যমে বিতরণ করা হচ্ছিল দীর্ঘদিন ধরে।
গত ২৬ জুলাই বিকালে পূর্ব ঘোষণা ছাড়া গ্লাক্সোস্মিথক্লাইন বাংলাদেশে তাদের উৎপাদন বন্ধ ঘোষণা করে।
ব্যবসা বন্ধ করে দেয়া দেশের জাতীয় উন্নয়ন অগ্রগতিতে অন্তরায় সৃষ্ঠি মন্তব্য করেন প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক কর্মচারিরা।
জিএসকে অলাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে বলে গত ২৬ জুলাই গ্লাক্সোস্মিথক্লাইনের সাপ্লাই চেইন প্রধান রাজু কৃষ্ণ স্বামীর বক্তব্যের বিরোধিতা করে সংবাদ সম্মেলনে তিনি জানান, এটি সত্যের অপলাপ মাত্র। শুধু ২০১৭ সালে এই প্রতিষ্ঠান ৬৬ কোটি ৯৩ লাখ চার হাজার টাকা নীট মুনাফা করেছে। প্রতি ১০ টাকার শেয়ারে ডিভিডেন্ট দিয়েছে ৫৫ টাকা। রাজস্ব ও ট্যাক্স দিয়েছে ১৯৯ কোটি ৪৪ লাখ ৭১ হাজার টাকা।
এ অবস্থায় প্রতিষ্ঠানটি অলাভজনক কিনাও প্রশ্ন তোলা হয় সংবাদ সম্মেলনে।
আজম বলেন, প্রতিষ্ঠান বন্ধ করার তৎপরতা আড়াল করতে গত দুই বছরে কারখানা আধুনিকায়ন ও কমপ্লায়েন্সের নামে কোটি কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। যাতে করে মুনাফা কম দেখানো যায়। এরপর তারা ব্যবসা রিভিউ করার নামে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। যার অধিকাংশ সদস্য বিদেশি।
এভাবে করে গ্লাক্সোস্মিথক্লাইন বন্ধ করার ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের দিকে ক্রমান্বয়ে এগিয়ে যায় বলেও মনে করেন শ্রমিকরা।
সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করা হয়, ষড়যন্ত্র কার্যকর করার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠানের নীতি নির্ধারকরা আগে থেকে কারখানার জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানি কমিয়ে দিয়েছিলেন। পাশাপাশি বাজারে চাহিদা থাকা উৎপাদিত অনেক ওষুধ গুদামে রেখে দিয়ে বাজারজাত করা হয়নি।
সংবাদ সম্মেলনে শ্রমিক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সম্পাদক সফর আলী বলেন, একটি প্রতিষ্ঠান লাভজনক বলেই গত বছর তারা শ্রমিক-কর্মচারিদের পাঁচ শতাংশ করে লভ্যাংশ দিয়েছিল। তারপরও প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ করা হয়েছে।
দ্রুত সময়ের মধ্যে কারখানা বন্ধের সিদ্ধান্ত বদল করে চালু করা না হলে রাজপথে আন্দোলনের হুমকিও দেন তিনি।
গ্লাক্সোস্মিথক্লাইন এমপ্লয়িজ ইউনিয়নের আইন বিষয়ক উপদেষ্ঠা অ্যাডভোকেট জানে আলম বলেন, একটি প্রতিষ্ঠান বন্ধ করার কিছু কারণ থাকে। এখানে কোন ধরনের কারণ বিদ্যমান নাই। এছাড়াও কিছু নিয়ম মেনে কারখানা বন্ধ করতে হয়। প্রতিষ্ঠানটি কোন ধরনের আইন মানেনি।
সরকার প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার হোল্ডার হলেও তারা সরকারকেও কিছু না জানিয়ে প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করে।
সংবাদ সম্মেলনে অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের সভাপতি তপন দত্ত, যুগ্ম সম্পাদক ইফতেখার কামাল খান, ইউনিলিভার শ্রমিক কর্মচারি ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি আখতারুজ্জামানসহ গ্লাক্সোস্মিথক্লাইন এমপ্লয়িজ ইউনিয়নের নেতারা।
সংবাদ সম্মেলন চলাকালীন সময়ে প্রতিষ্ঠানের কয়েক’শ কর্মচারি চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের বাইরে মানববন্ধন করেন।
ওষুধ খাতের কোম্পানি হিসেবে ১৯৭৬ সালের বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয় গ্লাক্সোস্মিথক্লাইন বাংলাদেশ লিমিটেড। ২০১৬ সালে শেয়ার মালিকদের ৫০০ শতাংশ এবং ২০১৭ সালে ৫৫০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিলেও চলতি বছরের জানুয়ারি-জুন সময়ের অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনে শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) ১৯ টাকা ২৭ পয়সা থেকে ১৫ টাকা ১৪ পয়সায় নেমে আসার কথা জানানো হয়।
৩০ জুন পর্যন্ত হিসাবে এ কোম্পানির শেয়ার প্রতি সম্পদ মূল্য (এনএভি) ছিল ১৭৮ টাকা ৪৯ পয়সা। যা আগের বছর একই সময় ১৮৩ টাকা ৯৩ পয়সা ছিল।
গ্লাক্সোস্মিথক্লাইন তাদের কারখানা বন্ধ বা বিক্রি করে দিতে পারে বলে গত দুদিন ধরেই পুঁজিবাজারে গুঞ্জন ছিল। কারখানা বন্ধের ‘ষড়যন্ত্র হচ্ছে’ অভিযোগ করে কোম্পানির কর্মীরা এক দিন আগে ঢাকায় সংবাদ সম্মেলনও করেন।
এর ধাক্কায় বৃহস্পতিবার এ কোম্পানির শেয়ারের দাম এক দিনেই ৮০ টাকা কমে ১২০৫ টাকায় নেমে আসে। গত নভেম্বরেও এই শেয়ারের দাম ১৭০০ টাকা ছিল।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের তথ্য অনুযায়ী, কোম্পানির মোট শেয়ারের ৮১ দশমিক ৯৮ শতাংশই রয়েছে উদ্যোক্তা-পরিচালকদের হাতে। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে রয়েছে ১৫ দশমিক ৯৩ শতাংশ। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা দশমিক ৯১ শতাংশ শেয়ারের মালিক। আর সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে রয়েছে মাত্র ১ দশমিক ১৮ শতাংশ শেয়ার।
Discussion about this post