জনতার কলামঃরমজান মাস চলছে। রোজার কারণে রাজনীতি অনেকটাই নেপথ্যে চলে গেছে, রাজপথ ছেড়ে ইফতার মাহফিলে। সম্প্রতি বিএনপির নেতারা বলেছেন, ঈদের পর তাঁরা জোরেশোরে মাঠে নামবেন, হার্ডলাইনে যাবেন ইত্যাদি। আওয়ামী নেতারা বলছেন, কোন ঈদের পর? এখন এসব কথাবার্তাই হচ্ছে।
বিএনপির একটি বড় অভিযোগ, দেশে গণতন্ত্র নেই। ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে একটি অবৈধ সরকার এসেছে। তারা জুলুম-নির্যাতন করে ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে চাইছে। বিএনপিকে মাঠে নামতে দিচ্ছে না, সভা-সমাবেশ করতে দিচ্ছে না, গায়ের জোরে মিথ্যা মামলা দিয়ে তাদের নেত্রী খালেদা জিয়াকে কারাগারে আটকে রেখেছে এবং তাঁকে বাদ দিয়ে একতরফা নির্বাচন করে আওয়ামী লীগ আবারও ক্ষমতায় যেতে চায় ইত্যাদি।
আওয়ামী লীগের নেতারা এসব অভিযোগের জবাবে বলে থাকেন, আমরাও তো একসময় বিরোধী দলে ছিলাম, অনেক জুলুম সহ্য করেছি। তারপরও আমরা আন্দোলন করেছি। তোমরা আন্দোলন করতে পার না কেন? আসলে তোমাদের সব বড় বড় কথা। তোমাদের আন্দোলন করার মুরোদ নেই।
দুই বিবদমান দলের সওয়াল-জবাবে সত্য আছে, অতিরঞ্জনও আছে। আর আছে ‘নির্ভেজাল’ রাজনীতি। রাষ্ট্রক্ষমতাকেন্দ্রিক লড়াইয়ে কেউ কাউকে এক ইঞ্চি জমিও ছেড়ে দেবে না। এটা বুঝতে না চাইলে কিছু করার নেই।
সরকারের অনুমতি ও সহযোগিতা নিয়ে কি ‘আন্দোলন’ হয়? আওয়ামী লীগের এ প্রশ্নের জবাবে বিএনপি কী বলবে? এ প্রসঙ্গে একটা উদাহরণ দিতে চাই। ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা ঘোষণা করেন। তারপর শুরু হয় আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীদের ওপর হয়রানি, নির্যাতন ও গ্রেপ্তার। মার্চে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে শেখ মুজিব সভাপতি নির্বাচিত হন। কাউন্সিলে ছয় দফা পাস হয়। দলের সাবেক সভাপতি আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ বিরোধিতা করে পাল্টা আওয়ামী লীগ তৈরি করলে অনেকেই সেই দলে ভিড়ে যান। দল দুর্বল হয়ে পড়ে। মে মাসে শেখ মুজিব গ্রেপ্তার হন। তারপর একে একে প্রায় সব নেতাকে জেলে ঢোকানো হয়। এ অবস্থায় দলটি ছয় দফার পক্ষে হরতাল ডাকে। দলের শক্তি বলতে তখন ছাত্রলীগ। অনুঘটকের ভূমিকায় নামেন ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল আলম খান। ছাত্রনেতাদের সঙ্গে নিয়ে তিনি হরতাল সফল করার সব আয়োজন করেন।
সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে সিরাজুল আলম খান আমাকে বলেছেন, ‘শ্রমিকদের মধ্যে আওয়ামী লীগের কোনো সংগঠন ছিল না। আমি আদমজীতে গেলাম। বের করলাম নোয়াখালী কানেকশন। পেয়ে গেলাম সাইদুল হক সাদুসহ অনেককে। একইভাবে তেজগাঁওতে যোগাযোগ করলাম। ৭ জুন সবাই রাস্তায় বেরিয়ে এল।’ এরপর তৈরি হয়েছিল ইতিহাস। ১১ জন শ্রমিক সেদিন পুলিশ আর ইপিআরের গুলিতে প্রাণ দিয়েছিলেন। মুশকিল হলো, বিএনপির মধ্যে একজন সিরাজুল আলম খান নেই। আর সময়টাও ষাটের দশক নয়।
গত ৩০ মে পালিত হলো প্রয়াত রাষ্ট্রপতি ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের প্রয়াণ দিবস। ওই দিন তারা চাইলে ঢাকায় বিপুলসংখ্যক লোকের সমাবেশ ঘটাতে পারত। পুলিশ প্রশাসন তো এ জন্য অনুমতি দেবে না। কখনো দেয় না। ষাটের দশকে এ দেশে যত আন্দোলন হয়েছে, তার কোনোটাই পুলিশের অনুমতি নিয়ে হয়নি।
কোটা সংস্কার আন্দোলনে যেভাবে সারা দেশে তরুণেরা পথে বের হয়েছিল, তেমন করে দেখাতে পারত বিএনপি ৩০ মে। তারা তা করেনি। তারা কিছু লোক নিয়ে চন্দ্রিমা উদ্যানে গেছে জিয়ার সমাধিতে ফুল দিতে, দোয়া-কালাম পড়তে। জিয়া তো কবর থেকে উঠে এসে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে পারবেন না।
পাকিস্তান আমলে তো সরকার আমাদের রাস্তায় নামতে বাধা দিয়েছে, জেলে ঢুকিয়েছে, কই আমরা তো আন্দোলন করে দেখিয়ে দিয়েছি—আওয়ামী লীগের নেতাদের এ কথায় এটাই মনে হতে পারে যে তখনকার আইয়ুব-মোনায়েম সরকারের সঙ্গে বর্তমানের শেখ হাসিনার সরকারের কোনো পার্থক্য নেই। অর্থাৎ বিরোধীদের দমন-পীড়ন আগে যেভাবে হয়েছে, এখনো সেভাবেই হচ্ছে। কথাটার মানে দাঁড়ায়, আইয়ুব-মোনায়েমের লেঠেলরা যেভাবে বিরোধীদের ঠেঙিয়েছে, বর্তমান সরকারও ওই ধারা বজায় রাখছে।
পারলে বিএনপি আন্দোলন করে দেখাক—আওয়ামী লীগের নেতাদের এই দৃষ্টিভঙ্গি তাঁদের দলের সংগ্রামী ঐতিহ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। আওয়ামী লীগ যদি নিজেকে গণতান্ত্রিক দল হিসেবে দাবি করে, তাহলে বিরোধী দলের সঙ্গে আচরণের বেলায় তাদের ষাটের দশকের ক্ষমতাসীনদের রীতিনীতি থেকে বেরিয়ে আসা উচিত। আওয়ামী লীগের নেতারা সম্ভবত ধরেই নিয়েছেন যে বিএনপি দেশবিরোধী দল, এরা দেশের চরম সর্বনাশ করেছে এবং আরও করবে, সুতরাং এদের পেটানো একটা ভালো কাজ।
বিএনপির কর্মকাণ্ড এখন বক্তৃতা, বিবৃতি আর প্রেস ব্রিফিংয়েই সীমাবদ্ধ। সরকার এমন কোনো চাপে নেই যে তারা বিএনপির দাবি মেনে নেবে। বরং সরকার তথা আওয়ামী লীগ বিএনপিকে ক্রমাগত কোণঠাসা করে চলেছে। বিএনপি আন্দোলন বা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারবে বলে মনে হয় না। এ দেশে সব গণ–আন্দোলনেই সংগঠকের ভূমিকায় ছিল তরুণেরা, বিশেষ করে ছাত্রসমাজ। এখন সেই তারুণ্য উধাও।
চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি করে ছাত্র নেতৃত্ব পচে গেছে। ছাত্রনেতারা সাধারণ ছাত্রদের আর প্রতিনিধিত্ব করেন না। কারণ, ভোটের জন্য ছাত্রদের কাছে তাঁদের যেতে হয় না। তাঁদের জবাবদিহি দলের নেতাদের কাছে, যাঁদের আনুকূল্যে তাঁরা পদ পেয়েছেন। নেতাদের হুকুমে তাঁরা প্রতিপক্ষের মিটিং-মিছিলে হামলা করতে পারবেন, দু-একজনকে ধরে এনে পায়ের রগ কেটে দিতে পারবেন, মিটিং-সমাবেশে চেয়ার ছোড়াছুড়ি করতে পারবেন, কিন্তু সাধারণ ছাত্রদের সঙ্গে নিয়ে কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারবেন না। এটা এখন প্রায় সব ছাত্রসংগঠনের জন্যই প্রযোজ্য।
বিএনপি নেতারা বলছেন, তাঁরা হার্ডলাইনে যেতে বাধ্য হবেন। হার্ডলাইনটা কী? এর মানে যদি হয় সহিংস রাজনীতি, তাহলে তা জনসমর্থন পাবে না। মানুষ শান্তি চায়, হুজ্জত-হাঙ্গামা চায় না। বিএনপির ভাষায় ‘এ অসহনীয় অবস্থা থেকে মুক্তি’ পেতে হলে তাদের ক্ষমতায় যেতে হবে। এখন ‘গণতন্ত্র’ নেই, তখন তারা গণতন্ত্র দেবে। খুব ভালো কথা। তো ক্ষমতায় যেতে হলে নির্বাচন ছাড়া তো কোনো বিকল্প নেই। সুতরাং বিএনপিকে নির্বাচনে যেতে হবে। নির্বাচনে জিতে সরকার গঠন করতে হবে। তখন খালেদা জিয়াকে জেলে আটকে রাখে, কার সাধ্যি?
কথা উঠেছে, ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ না হলে বিএনপি নির্বাচনে না-ও যেতে পারে। কেউ কেউ বলছেন, ২০১৪ সালে নির্বাচনে না গিয়ে বিএনপি ভুল করেছিল, এবার নির্বাচনে গেলে আবারও ভুল করবে। বোঝা মুশকিল, বিএনপি আসলে কোন কৌশলটা নেবে।
বিকল্প একটি আছে। এটা সর্বজনস্বীকৃত গণতান্ত্রিক বিকল্প। সমাজের সব অংশকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপি একটি গণ–অভ্যুত্থান ঘটাতে পারে। যেমনটি আমরা দেখেছি ১৯৬৯ সালের ২৪ জানুয়ারি ও ১৬ ফেব্রুয়ারি এবং ১৯৯০ সালের ৪-৬ ডিসেম্বর। বিএনপি কি পারবে তাদের দাবির সমর্থনে ঢাকায় দশ লাখ লোকের সমাবেশ ঘটাতে? লাগাতার শান্তিপূর্ণ অবস্থান ধর্মঘট করতে? সবকিছু অচল করে দিতে? তাদের কি সাংগঠনিক সক্ষমতা এবং রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তি আছে এ ধরনের ব্যাপক আয়োজন করার? যদি না থাকে, তাহলে তাদের নির্বাচনে যাওয়া ছাড়া আর তো কোনো বিকল্প দেখি না। অন্য কেউ এসে কি তাদের পথ মসৃণ করে দেবে? কে দেবে? কেন দেবে?
মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক(জনতার কলাম)