জনতার কলামঃযে জাতি তার পূর্ব পুরুষের বীরত্বগাঁথা এবং ত্যাগের কথা জানে না, সে জাতির জাতীয়তাবোধ এবং দেশাত্মবোধ তিল মাত্র জন্মাতে পারে না। সে জাতি পৃথিবীতে কখনো মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না। তাই আজ দেশের ইতিহাসবিদ ও গবেষকদের উচিত নিরপেক্ষ ইতিহাস রচনায় উদ্যোগী ভূমিকা রাখা। স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ের নেতা ও সংগঠকদের উচিত সেই ইতিহাস রচনায় সহযোগিতা করা। আর স্বাধীনতা আন্দোলনে ও মুক্তিযুদ্ধে যারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন তাদের উচিত নিজেদের কৃতিত্ব উপস্থাপনের পাশাপাশি অন্যের অবদানকে খাটো বা অস্বীকার না করে নিরপেক্ষ ইতিহাস রচনায় সচেষ্ট হওয়া।–কাজী আরেফ আহমেদ
১৯৯৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারী দৌলতপুর উপজেলার কালিদাসপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠের জনসভায় ভাষনরত অবস্থায় জাতীয় বীর কাজী আরেফ আহমেদ, কুৃষ্টিয়া জেলা জাসদের সভাপতি বীরমুক্তিযোদ্ধা লোকমান হোসেন, সাধারন সম্পাদক ও দৌলতপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান বীরমুক্তিযোদ্ধা এ্যাড.ইয়াকুব আলী, আড়িয়া ইউনিয়ন জাসদের অন্যতম নেতা ইসরাইল হোসেন তফসের,শমসের আলী মন্ডল সন্ত্রাসীদের ব্রাশ ফায়ারে নিহত হন।
এই ১৬ ই ফেব্রুয়ারী মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, জাতীয় বীর কাজী আরেফ আহমেদের ২০তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৯৯ সালের এদিনে কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে এক সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশ চলাকালীন সময়ে উগ্রপন্থি সন্ত্রাসীদের গুলিতে শহীদ হন বাঙালি জাতিসত্তার ভিত্তিতে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অন্যতম সংগঠক কাজী আরেফ আহমেদ। কাজী আরেফের মতো নেতা বারবার জন্মায় না। তিনি নেই, রেখে গেছেন তার অসমাপ্ত সংগ্রামী জীবন। তার কাছ থেকে প্রেরণা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের দেখানো পথে পথ চলতে হবে আমাদের।
যেভাবে খুন করা হয় কাজী আরেফকেঃ
১৯৯৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি বিকাল বেলা। কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার কালীদাসপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে স্থানীয় সমাজতান্ত্রিক দল— জাসদের সন্ত্রাসবিরোধী জনসভা চলছে। বিদ্যালয়ের ছোট্ট মাঠে হাজার খানেক মানুষ নেতাদের বক্তৃতা শুনছেন। ঘড়ির কাঁটা তখন বিকাল পৌনে ৫টার ঘর ছুঁই ছুঁই। জনসভায় বক্তৃতা দিতে উঠলেন জাসদের তৎকালীন সভাপতি মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক কাজী আরেফ আহমেদ। তার বক্তৃতা শুরুর কয়েক মিনিটের মধ্যেই একদল সন্ত্রাসী নির্বিচারে গুলি চালিয়ে কাজী আরেফসহ ৫ জাসদ নেতাকে হত্যা করে। জনসভা পরিচালনা করছিলেন সরকারি কলেজ ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি কারশেদ আলম। তার স্মৃতিতে সেদিনের লোমহর্ষক ঘটনা আজও অমলিন। তিনি বলেন, শেষ বক্তা হিসেবে আরেফ ভাই দুই থেকে তিন মিনিট বক্তব্য দেওয়ার পর জনসভা মঞ্চের পূর্ব পাশ থেকে এসে সন্ত্রাসীরা গুলি ছোড়া শুরু করে। হামলায় ৯ থেকে ১০ জন অংশ নেয়। সবার হাতে ছিল ভারী অস্ত্র। তারা প্রথমে তৎকালীন কুষ্টিয়া জেলা জাসদ সভাপতি লোকমান হোসনের ওপর গুলি চালায়। এরপর জেলা জাসদের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট ইয়াকুব আলীও গুলিবিদ্ধ হন। কারশেদ আলম জানান, দুই নেতা গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর কাজী আরেফ আহমেদ সন্ত্রাসীদের নিবৃত করার চেষ্টা করেন। সন্ত্রাসীরা ওই সময় কাজী আরেফকে মঞ্চ থেকে নেমে আসার জন্য বারবার অনুরোধ করে। এক পর্যায়ে কাজী আরেফকে প্রচণ্ড গালমন্দ করেন তারা। সে সময় কাজী আরেফ খুনিদের অনুরাধ করে বলে, তোমরা আমাকে মার। কোথায় যেতে হবে বল আমি যাচ্ছি। কিন্তু অন্যদের মেরো না। এই কথা বলার পরপরই সন্ত্রাসীরা তার ওপর ব্রাশ ফায়ার করে। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আমাদের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের প্রতীক জাতীয় পতাকার রূপকার কাজী আরেফ আহমেদের নিথর দেহ। কারশেদ আলম বলেন, কাজী আরেফের শরীরে তিনটি বুলেট বিদ্ধ হয়েছিল। এর দুটি বুকের দুপাশে এবং অপরটি মাথা ফুঁড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। কারশেদ আলমের ভাষায়, ‘সন্ত্রাসীরা খুব নৃসংশভাবে এ হত্যাযজ্ঞ চালায়। ’ ইয়াকুব আলী, লোকমান হোসেন, ইসরাইল হোসেন ও শমসের মণ্ডল গুলি খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেও ক্ষান্ত হয়নি সন্ত্রাসীরা। এ সময় সন্ত্রাসীরা প্রত্যেকের লুটিয়ে পড়া শরীরে অস্ত্র ঠেকিয়ে পুনরায় গুলি করে। ’ পরে এ মামলার অন্যতম সাক্ষী হন কারশেদ আলম। রায় কার্যকর হতে যাচ্ছে জেনে তিনিও আনন্দিত। তিনি বলেন, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বছরের পর বছর ধরে আদালতের বারান্দায় ঘুরে শেষ পর্যন্ত আদালতের রায় কার্যকর হচ্ছে জেনে ভালো লাগছে। বছরের পর বছর অপেক্ষা করেছিলাম এ রকম একটি দিনের জন্য। এই হত্যাকারীদের ফাঁসির রায় কার্যকরের মধ্য দিয়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হবে। এদিকে, ওই ঘটনায় নিহত জেলা জাসদ সাধারণ সম্পাদক অ্যাভোকেট ইয়াকুব আলীর ছেলে ইউসুফ আলী রুশো বলেন, তিন ঘাতকের রায় কার্যকর করা হবে খবরে তারা খুশি। তবে এখনো ৫ খুনি পলাতক। সবার শাস্তি যেদিন কার্যকর হবে সেদিন তার বাবার আত্মা শান্তি পাবে। পাশাপাশি রুশো, এই হত্যাযজ্ঞের মূল পরিকল্পনাকারীদের খুঁজে বের করে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান।
মুক্তিযুদ্ধে কাজী আরেফের অবদান :
কাজী আরেফ আহমেদ মূলত একজন জনদরদি, আত্মমর্যাদাশীল, নির্লোভ মানুষ ছিলেন। রাজনৈতিক আদর্শ বাস্তবায়ন প্রশ্নে তিনি ছিলেন একরোখা ও জেদি। আইয়ুবের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনই কাজী আরেফ আহমেদকে রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে গড়ে তোলে। ১৯৬২-এর নভেম্বরে সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমেদ বাংলাদেশে স্বাধীন করার সিদ্ধান্তে এক মতে পৌঁছান। এটাই ৬২-এর নিউক্লিয়াস নামে পরিচিত। পরে যার নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ নামে সশস্ত্র যুদ্ধের লক্ষ্যে একটি গোপন সংগঠন গড়ে উঠেছিল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৬ দফা কর্মসূচি ঘোষিত হলে, ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগ সভাপতি হিসেবে কাজী আরেফ আহমেদ প্রথম সমর্থন জানিয়ে বিবৃতি দেন। বাংলাদেশের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে ১৯৭০ সালে গঠিত ‘জয় বাংলা বাহিনী’র অন্যতম সংগঠকও ছিলেন তিনি। কাজী আরেফ আহমেদ স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের প্রতীক জাতীয় পতাকার অন্যতম রূপকার। দীর্ঘদিন ধরে লালিত স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নসাধ ১৯৭১ সালের সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামের মাধ্যমে বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া শুরু হয়, তার সূচনালগ্নে কাজী আরেফ আহমেদ বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্টের অন্যতম নেতার ভূমিকা পালন করেন। এই বাহিনীর নেতা হিসেবে তিনি মুক্তিযুদ্ধে পশ্চিম রণাঙ্গনের (বৃহত্তর পাবনা, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, খুলনা ও বরিশাল) নেতৃত্ব দেন। ১৯৯২ সালে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে গণআদালত গঠনেও কাজী আরেফ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন
কাজী আরেফের প্রয়াণ দিবসে তাঁর প্রতি অশেষ শ্রদ্ধা ।বীর বিপ্লবী কাজী আরেফকে লাল সালাম।।
Discussion about this post