জনতার কলামঃমাসখানেক আগে ব্রিটেনের প্রভাবশালী পত্রিকা ‘দ্য গার্ডিয়ানে’ ১৫ জন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদের একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। লেখকদের মধ্যে নোবেলজয়ী আঙ্গাস ডিটন, জেমস হিকম্যান ও জোসেফ স্টিগলিটজও ছিলেন। তাঁরা দারিদ্র্র্য বিমোচনে সহায়তা বা দানের কার্যকারিতা নিয়ে বিশ্বব্যাপী যে উন্মত্ততা চলছে, তার সমালোচনা করে বলেছেন, এটি বৈশ্বিক দারিদ্র্যের মূল কারণ থেকে নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি অন্যত্র সরিয়ে রাখছে।
আমি সহায়তা বা দানের অধিক কার্যকারিতা নিশ্চিতের জন্য সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহারের জন্য অধিক ব্যয়সাশ্রয়ী পদ্ধতিকে বেছে নেয়ার পরামর্শ দেব। এ পরিপ্রেক্ষিতে আমি ‘দ্য লাইফ ইউ ক্যান সেভ’ নামক একটি সংস্থার সংগৃহীত তথ্য-উপাত্তের সহায়তা নেব। সংস্থাটি মানুষকে বিভিন্নভাবে দান-খয়রাত প্রদানে উৎসাহিত করে তাদের ফান্ড সংগ্রহ করে। দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্য অর্জন ও দারিদ্র্যের অন্তর্নিহিত কারণগুলো অনুসন্ধান এবং তা সমাধানে ব্যক্তির প্রদত্ত সাহায্যের দ্বারা আরো ভালো কাজ করার সম্ভাবনা বা সুযোগ রয়েছে বলেই আমি মনে করি।
ডিটন, হিকম্যান, স্টিগলিটজ ও তাঁদের সহকর্মীরা বলতে শুরু করেছেন, বৈশ্বিক দারিদ্র্য পরিস্থিতি এখনো উদ্বেগজনক পর্যায়ে রয়েছে। তাঁদের এ বিবৃতি দারিদ্র্য বিমোচনে আমরা কোনো অগ্রগতিই অর্জন করতে পারছি না— এ দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রতিফলিত করে।
কিন্তু পরিস্থিতি এমন নয়। বিশ্বব্যাংক হতদরিদ্রদের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলছে, তাদের পর্যাপ্ত খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানসহ অন্যান্য মৌলিক মানবিক চাহিদা পূরণের জন্য নির্ভরযোগ্য কোনো আয় থাকে না। বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ প্রাক্কলন অনুযায়ী, ৭৬ কোটি ৮৫ লাখ মানুষ অতিদারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে, যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ১০ দশমিক ৭ শতাংশ। অথচ আমরা এমন একপর্যায়ে উপনীত হয়েছি, যেখানে বিশ্বের সবার মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য যথেষ্ট পণ্য ও সেবা উৎপাদন হয়। তার পরও ১৯৯০ সালে বিশ্বের ৩৫ শতাংশ জনগণ অতিদারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করত। সর্বসাম্প্রতিক অর্থাৎ ২০১২ সালে অতিদারিদ্র্যের সংখ্যা কমে ১২ দশমিক ৪ শতাংশে নেমে এসেছে। তথ্য-উপাত্ত বলছে, দারিদ্র্য বিমোচনে দীর্ঘমেয়াদি প্রবণতা ইতিবাচক। মানুষের কল্যাণের অন্যান্য সূচকেও অগ্রগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ শিশুমৃত্যুর বিষয়টি উল্লেখ করা যেতে পারে। ১৯৯০ সালে শিশুমৃত্যুর হার (হাজারে) ৯৩ থেকে ৪০-এ নেমে এসেছে।
অর্থনীতিবিদদের নিবন্ধ আমাদের আরো বলছে, বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্য বিমোচনে ব্যয়িত শত শত কোটি ডলারের সহায়তা বা দান লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। কোনো সময় নির্দিষ্ট করে এমন সিদ্ধান্ত টানেননি তাঁরা। কিন্তু আমার মতো হয়তো অনেক পাঠক অনুমান করছেন, বিশ্ব প্রতি বছর দারিদ্র্য বিমোচনে শত শত কোটি ডলার ব্যয় করে। ২০১৭ সালে বিশ্বের উন্নত অর্থনীতির দেশগুলো থেকে আনুষ্ঠানিক উন্নয়ন সহায়তা (ওডিএ) হিসেবে ১৪ হাজার ৬৬০ কোটি ডলার পাওয়া যায়। যদি সহায়তা হিসেবে প্রাপ্ত এ অর্থের পুরোটাই বিশ্বের অতিদারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করা ৭৬ কোটি ৮৫ লাখ মানুষের কাছে পৌঁছানো হয়, তবে প্রত্যেকে মাথাপিছু ১৯১ ডলার করে পাবে। যদিও আনুষ্ঠানিক উন্নয়ন সহায়তার মাত্র ৪৫ শতাংশ অনুন্নত বা স্বল্পোন্নত দেশগুলোয় পৌঁছে। এ অর্থে পরিচালিত কার্যক্রমের কার্যকারিতার সামান্যই প্রমাণ হয়েছে। আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না যদি জানা যায়, ভুলভাবে পরিচালিত এ সামান্য সহায়তা বা দানও অতিদারিদ্র্য থেকে মানুষকে বের করে আনতে বা অতিদারিদ্র্য দূরীকরণে কোনো ভূমিকাই রাখেনি।
১৫ অর্থনীতিবিদের পরবর্তী লক্ষ্য, এলোমেলোভাবে নিয়ন্ত্রিত পরীক্ষার মাধ্যমে দেখা দারিদ্র্য বিমোচনে হস্তক্ষেপ কতটা কার্যকর। তাদের মতে, এমন পরীক্ষা অনেক ব্যয়বহুল। তবে দারিদ্র্য বিমোচনের উদ্দেশ্যে নেয়া প্রকল্পের (যাদের কোনো কার্যকারিতা নেই) চেয়ে এটি কম ব্যবহুল। এলোমেলো পরীক্ষা সর্বদা প্রযোজ্য নাও হতে পারে এবং এটি কোনো প্রকল্পের কার্যকারিতা পরীক্ষার একমাত্র পথ নয়। কিন্তু যখন তথ্য-উপাত্ত সহজলভ্য হয়, তখন দেখা যায় দারিদ্র্যের জন্য দানের ইতিবাচক ভূমিকা রয়েছে। ম্যালেরিয়ার জীবাণু বহনকারী মশার আক্রমণ থেকে শিশুকে রক্ষায় দরিদ্র জনগণের মধ্যে মশারি বিতরণ যে স্বল্প ব্যয়েও জীবন বাঁচায়, তার দৃঢ় প্রমাণ মেলে।
তবে এ ধরনের প্রমাণ নিয়ে অর্থনীতিবিদদের আপত্তি রয়েছে। এসব উদাহরণ আমাদের মাইক্রো ইন্টারভেনশনকে উৎসাহিত করে, যা দারিদ্র্যের অন্তর্নিহিত কারণ অনুসন্ধান ও তা মোকাবেলায় যথেষ্ট নয়। এসব আপত্তির শক্তি আরো ভালো বিকল্পের প্রাপ্যতার ওপর নির্ভর করে।
তারা কী পরামর্শ দিচ্ছেন? তারা বলছেন, দারিদ্র্যের প্রয়োজন মানসম্পন্ন শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা। এক্ষেত্রে তাদের পরামর্শ হলো, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় সরকারি নীতির সমন্বয়। কৃষির অগ্রগতি বা উন্নয়নের জন্য উন্নত দেশগুলোর উচিত কৃষি থেকে মাত্রাতিরিক্ত ভর্তুকি প্রদানের সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসা।
অন্য পরামর্শের মধ্যে রয়েছে, বহুজাতিক কোম্পানি কর্তৃক কর ফাঁকি দেয়ার প্রবণতা বন্ধ, ট্যাক্স হ্যাভেন (যে দেশে সম্পদ বা আয় রাখলে কর দিতে হয় না) হিসেবে পরিচিত স্থানগুলো নিয়ন্ত্রণ এবং শ্রমসংক্রান্ত আইন-কানুন উন্নত করা, যাতে বিশ্বায়নের ফলে সৃষ্ট শ্রমিকের নিচের দিকে নামার প্রতিযোগিতা বন্ধ হয়। দারিদ্র্য বিমোচনে কোন নীতি বেশি কার্যকর, তা বোঝার জন্য আমরা বলেছি, আমাদের উচিত অব্যবহূত বা স্বল্প ব্যবহূত তথ্য-উপাত্ত ও স্যাটেলাইট থেকে প্রাপ্ত ছবির সহায়তা নিয়ে একটি চিত্রাঙ্কন করা। আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো, নীতি, আইন-কানুন পরিবর্তনপূর্বক আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে আরো বেশি পরিবেশসহায়ক ও বিশ্বের অধিকাংশ মানুষের জন্য সমতাধর্মী বা ন্যায্য করে তোলা।
এগুলো অবশ্যই প্রশংসনীয় লক্ষ্য। কিন্তু কোন অর্থনীতিবিদরা এসব বিষয় তুলে ধরছেন? স্বতন্ত্রভাবে কে দান করছে? সহায়তা থেকে প্রাপ্ত অর্থ বণ্টনের জন্য সরকারের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা দায়ী নাকি সরকার? প্রস্তাবিত পরিবর্তন আনতে সরকারই একমাত্র ক্ষমতার অধিকারী।
যদি এসব যুক্তি সরকার সঠিক ও যথাযথভাবে চিহ্নিত করতে চায়, তবে তার জন্য নির্ভুল ও যথাযথ তথ্য-উপাত্তের প্রয়োজন পড়বে। কারণ নির্ভুল তথ্য থেকেই সবচেয়ে ভালো ফলাফল আসবে। উদাহরণস্বরূপ যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিতে ভর্তুকির কথাটি বলা যায়। যদি কেউ বিষয়টিকে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে বিশ্লেষণের চেষ্টা করেন, তবে তিনি দেখবেন, যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিতে প্রদত্ত ভর্তুকি বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্যকে ক্ষতি করছে এবং সরকারি তহবিলের বিপুল অপচয় হচ্ছে। কৃষি থেকে ভর্তুকি প্রত্যাহার করে নেয়ার চেষ্টা বারবার ব্যর্থ হচ্ছে। এর জন্য শুধু নীতি বিশ্লেষণের অভাবই দায়ী নয়, রাজ্যগুলোর রাজনৈতিক ক্ষমতা ধরে রাখার বিষয়ও রয়েছে এখানে।
দ্য লাইফ ইউ ক্যান সেভ ও গিভওয়েলের মতো সংগঠন স্বতন্ত্র দাতাগোষ্ঠীকে প্রভাবিত বা উৎসাহিত করে, যাতে তারা তাদের পণ্য ও সেবা সরাসরি দানের বিষয় চিন্তাভাবনা করে। আমি আশা করি, সমতাধর্মী ও অধিক টেকসই বিশ্ব ব্যবস্থা নিশ্চিতে তারা সরকারকে চাপ প্রয়োগে সক্রিয় নাগরিকের ভূমিকা পালন করবে। কিন্তু যখন আমরা বৈশ্বিক দারিদ্র্যের মূল কারণগুলো মোকাবেলা বা সমাধানে রাজনীতিকদের ওপর নির্ভর করি, তখন আমাদের অনেক দীর্ঘ সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে হতে পারে। আসুন, আমাদের অতিরিক্ত সম্পদকে কার্যকর দান বা সহায়তা ব্যবস্থা প্রবর্তনে ব্যয় করি, যা হতদরিদ্রকে নিজ স্থান থেকে সর্বোত্তম জীবনযাপনে সহায়তা করবে।
লেখক :
প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির বায়োএথিকসের অধ্যাপক ও ইউনিভার্সিটি অব মেলবোর্নের লরেট প্রফেসর
সূত্র : বণিক বার্তা
Discussion about this post