জনতার কলাম-লেখক সিএমপি কোতোয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মুহাম্মদ মহসিনঃ দিন বদলের গল্প’ এই পাখি, সেই পাখি সিএমপির কোতোয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মুহাম্মদ মহসিন পি.পি.এম। আদমশুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতিদিন জন্মগ্রহণ করে ৫ হাজার ২শত ৮৬ জন। কিন্তু ১লা ডিসেম্বর ২০১৬ তে জন্মগ্রহণ করে ১ জন বেশী। জন্মগ্রহণের সময় সব শিশুর বয়স ১ দিন হলেও সেই অতিরিক্ত একজন জন্মগ্রহণ করে ৪২ বছর বয়সে! ৪২ বছরের সেই নবজাতকের নাম পাখি। জন্মদাতা বাংলাদেশ পুলিশ। আরেকটু নির্দিষ্ট করে বললে আমার সাবেক কর্মস্থল বায়েজিদ বোস্তামি থানা। ব্যক্তিগত উদ্যোগ, সহকর্মীদের আন্তরিকতা এবং বাংলাদেশ পুলিশের সহযোগিতায় এই বছরই অপরাধের অন্ধকার জগত থেকে স্বাভাবিক জীবনের আলোতে ফেরে পাখি। বাংলাদেশ পুলিশের তৎকালীন মহাপরিদর্শক এ.কে.এম শহীদুল হক, বিপিএম, পিপিএম, স্যার হাতে সেলাই মেশিন তুলে দিয়ে পাখিকে আলোর ভুবনে স্বাগত জানান। একদিনের ব্যবধানেই মাদক সম্রাজ্ঞী বনে যায় টেইলার্স মালিক। শপথে সুপথে ৫ এপ্রিল, ২০১৬। ৭ম বারের মতো গ্রেফতার হয় পাখি। তাকে গ্রেফতার করা হয় মূলত কমিউনিটি পুলিশিংয়ের মাধ্যমে। একদি কমিউনিটি পুলিশের এক সভায় এলাকাবাসীকে অনুরোধ জানাই মাদকের বিরূদ্ধে রুখে দাঁড়াতে। মাদক ব্যবসায়ীদের গ্রেফতারে সহযোগিতা করতে। এলাকাবাসী তাতে সাড়া দেয়। তাদের সহযোগিতায় গ্রেফতার করা হয় পাখিকে। তাকে গ্রেফতার করে বিরক্ত হয়ে আমার এক সহকর্মী বলেন, ‘স্যার, এরে নিয়ে আর পারি না। প্রতিবারই ধরি। জেলে পাঠাই। কিন্তু ছাড়া পেয়ে আবারও আগের কাজ শুরু করে।’ তখন বুঝতে পারলাম, এইভাবে তাকে সুপথে আনা যাবে না। বিকল্প কিছুই করতে হবে তার জন্য। সবাইকে বিদায় করে ডাকলাম পাখিকে। জানতে চাইলাম মাদক বিক্রির কারণ। সে জানাল তার বিরূদ্ধে বেশ কিছু মামলা চলমান। এসব মামলা চালানোর জন্য তার প্রতি সপ্তাহেই টাকা প্রয়োজন। তাই বাধ্য হয়েই এই পথে থাকতে হচ্ছে তাকে। তাকে জিজ্ঞেস করি, তার মামলা চালানোর টাকার যদি বিকল্প কোন সংস্থান তাকে দেওয়া হয় তাহলে সে এই অন্ধকার জগত থেকে ফিরে আসবে কিনা । তখন সে শপথ করে সাপ্তাহিক টাকার ব্যবস্থা করতে পারলে সে মাদক ব্যবসা ছেড়ে দিবে। এরপর কমিউনিটি পুলিশিংয়ের মাধ্যমে তার জন্য বিকল্প আয়ের সংস্থান করি। দুইয়ে দুইয়ে চার মিলে যাওয়ার পর তার সুপথে ফেরার আনুষ্ঠিানিকতার দিন ধার্য করা হয়। পরে আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, ১ ডিসেম্বর ২০১৬। কমিউনিটি পুলিশ সপ্তাহের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে পাখির হাতে সেলাই মেশিন তুলে দেন তৎকালীন পুলিশের মহাপরিদর্শক এ.কে.এম শহীদুল হক, বিপিএম, পিপিএম, স্যার। এভাবেই এক শপথে সুপথে ফিরে পাখি। শুরু হয় তার দিন বদলের স্বপ্নযাত্রা। সেই পাখি, এই পাখি পাখি বদলেছে। বদলেছে তার ভাগ্যও। তার এই বদলে যাওয়ার যাত্রার বড় একটা অংশজুড়েই আছি আমি। তাই মাঝে মাঝেই দেখতে আসে আমায়। সেদিন পাখি আমাকে দেখতে আসে। এক হাতে নাস্তার বক্স। অন্য হাতে একটি পোশাক। তার নিজের বানানো। দুটি উপহারই আমার জন্য। এই দৃশ্য দেখে আমি আবেগ সংবরণ করতে পারিনি। পাখির সাথে এটা আমার প্রথম দেখা নয়। এর আগেও তার সাথে অনেকবার দেখা হয়েছে। তবে অতিথি হিসেবে নয়; কয়েদী হিসেবে। পরিবর্তিত পেশায় বদলে যাওয়া পাখিকে দেখে যে স্বর্গীয় প্রশান্তি অনুভব করেছি তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। পরে জানতে চাই বদলে যাওয়া জীবনের অভিজ্ঞতা। পাখি জানাল, আয় আগে বেশী হতো। সাথে ছিল এলাকাবাসীর ঘৃণা, বিবেকের দংশন আর পুলিশের চোখ রাঙানি। এখন আয় কম। কিন্তু সাথে পাচ্ছেন এলাকাবাসীর ভালবাসা, নিরন্তর প্রশান্তি আর পুলিশের সহযোগিতা। পাখি জানায়, একটি মেশিন দিয়ে নতুন জীবন শুরু করলেও এখন সাথে যুক্ত হয়েছে একটি স্টেশনারী দোকান। পরিকল্পনা আছে তার আরও দুইটি নতুন মেশিন কেনার। পরিকল্পনা আছে তার বদলে যাওয়া জীবনের অভিজ্ঞতা অন্ধকার জগতের বাসিন্দাদের সাথে শেয়ার করার। তার মতো বিপথে যাওয়া মানুষদের ফেরাতে কাজ করতে চায় সে। অভিশপ্ত সেই জীবনের জাবর আর কাটতে চায় না সে। সে জানায়, এই জীবনেরই অপেক্ষা ছিল তার। সেই পাখি নয়; এই পাখিতেই গর্বিত সে। পাখি ছেড়েছে, পাখিকে ছাড়েনি শপথ করে সুপথে এসে অন্ধকার জগত ছেড়েছে পাখি। কিন্তু সে অন্ধকার জগত যেন হাতছানি দিয়ে আবারও ডাকছে পাখিকে! আগের সেসব মামলা এখনও চলছে। প্রতি সপ্তাহেই তাই তার কমপক্ষে এক হাজার টাকা প্রয়োজন। শুধু সেলাই কাজ করে দৈনন্দিন জীবন চলার পাশাপাশি মামলা চালানো দুরূহ হয়ে পড়ছে। এই কারণে সে সহযোগিতা চেয়েছে আইনজীবীদের। বাংলাদেশ পুলিশ তার দায়িত্ব পালন করেছে। এখন অন্যদের পালা তাদের দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেওয়ার। পাখির নতুন এই জীবনও তাকিয়ে আছে তাদের দিকে।