স্বাধীনতা-পরবর্তী বিচার বিভাগের ঘটনাপ্রবাহ পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, দীর্ঘ মেয়াদে প্রধান বিচারপতি পদ শূন্য রাখার নজির নেই। বাংলাদেশে এর আগে দুবার প্রধান বিচারপতি নিয়োগে বিলম্ব হলেও এবার দীর্ঘসূত্রতা রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। গত ১০ নভেম্বর দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ মাথায় নিয়ে সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশ হাইকমিশনে পদত্যাগপত্র জমা দেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। এটি দেশের ইতিহাসে কোনো প্রধান বিচারপতির পদত্যাগের প্রথম ঘটনা। মেয়াদ শেষ হওয়ার ৮২ দিন আগেই তিনি পদত্যাগ করেন। সিঙ্গাপুর হাইকমিশন থেকে পরদিন প্রধান বিচারপতির পদত্যাগপত্র রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ে পাঠানো হয়। পরে ১৪ নভেম্বর আইন মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়, রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতির পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেছেন। এরই ধারাবাহিকতায় গত মঙ্গলবার এক অনুষ্ঠানে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, শিগগিরই আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগে বিচারপতি নিয়োগ করা হবে। তবে তিনি প্রধান বিচারপতি নিয়োগের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি। এর ফলে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ নিয়ে কী হচ্ছে, তা নিয়ে বিচারাঙ্গনের পাশাপাশি জনমনেও প্রশ্ন উঠেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহ্দীন মালিক সমকালকে বলেন, ‘এককথায় খুবই অস্বাভাবিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। দুই মাস ধরে প্রধান বিচারপতির পদ শূন্য। এ পরিস্থিতিতে গুঞ্জন ছড়াচ্ছে। যেটা সরকারের জন্য, গণতন্ত্র, আইনের শাসন এবং উন্নয়ন ও রাজনীতির জন্য সুখকর নয়। দ্রুত এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতির অবসান হওয়া উচিত।’
সংবিধান অনুযায়ী, প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শ করেই উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগ করতে হবে। এ ছাড়া নতুন বিচারপতি নিয়োগ করা হলে তাকে শপথও পড়াবেন প্রধান বিচারপতি। তাই অস্থায়ী বা ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞার শপথ পড়ানোর সুযোগ নেই। কারণ, তিনি নিজেই প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ নেননি।
প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা পদত্যাগ করার দুই মাস পরও পদটি এখনও শূন্য ঘোষণা করা হয়নি। বিধি অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতির পদত্যাগপত্র গ্রহণের পর পরই ওই পদ শূন্য ঘোষণা করে গেজেট জারি হওয়ার কথা। অথচ এর মধ্যে আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগে নতুন করে বিচারপতি নিয়োগের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এর ফলে শিগগিরই প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ দেওয়া হবে কি-না, তা নিয়ে শুরু হয়েছে নানা আলোচনা।
পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক আইন মন্ত্রণালয়ের এক জ্যেষ্ঠ বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা বলেন, পদ শূন্য হওয়ার আগে-পরে রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দিয়ে থাকেন। তবে এবার পরিস্থিতি ও প্রেক্ষাপট ভিন্ন। এ জন্যই প্রধান বিচারপতি নিয়োগে বিলম্ব হচ্ছে। নয়তো স্বাভাবিকভাবে এত দিনে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ হতো। অবশ্য একটি সূত্র দাবি করছে, ৩১ জানুয়ারির আগে-পরে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করা হবে। এর পরপরই আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগেও বিচারপতি নিয়োগ সম্পন্ন হবে।
প্রধান বিচারপতির পদ শূন্য রেখে উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগ করা হলে তাদের শপথ পড়ানোর বিষয়ে শাহ্দীন মালিক বলেন, সংবিধান অনুযায়ী নবনিযুক্ত বিচারপতিকে প্রধান বিচারপতি শপথ পড়াবেন। এখন ওই পদ শূন্য থাকা অবস্থায় বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হলে তাকে কে শপথ পড়াবেন, সেটাই প্রশ্ন। অস্থায়ী প্রধান বিচারপতি এ ক্ষেত্রে শপথ পড়াতে পারবেন না।
সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, প্রধান বিচারপতি পদত্যাগ করেছেন। অথচ তার পদ এখনও শূন্য ঘোষণা করা হচ্ছে না। এর কারণ বুঝতে পারছি না। আগে ওই পদ শূন্য ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশ করতে হবে। শিগগিরই প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দিয়ে রাষ্ট্রপতি তার সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করবেন বলেও প্রত্যাশা করেন তিনি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, সংবিধান অনুযায়ী প্রধান বিচারপতির পদ এক ঘণ্টাও খালি রাখার সুযোগ নেই। দেশে এমন কোনো বিশেষ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি যে কাউকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া যাবে না। এ ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা রহস্যজনক।
সুপ্রিম কোর্টের তথ্যানুসারে, দেশের প্রথম প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম ১৯৭৫ সালের ৫ নভেম্বর অবসরে যান। পরে ১৮ নভেম্বর দ্বিতীয় প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ নেন বিচারপতি সৈয়দ এ বি মাহমুদ হোসেইন। দ্বিতীয় দফা প্রধান বিচারপতি নিয়োগে বিলম্বের ঘটনা ঘটে ১৯৯০ সালে। দেশের পঞ্চম প্রধান বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরী ১৯৯০ সালের ১ জানুয়ারি অবসরে যাওয়ার পর ১৩ দিন ওই পদ শূন্য ছিল। এর পর একই বছরের ১৪ জানুয়ারি প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ নেন বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ। অবশ্য পরে প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ সাংবিধানিক কাঠামোর আওতায় তৎকালীন এরশাদ সরকারের পতনের পর রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। এ জন্য সংবিধান সংশোধন করে নতুন রাষ্ট্রপতি দায়িত্ব গ্রহণের পর বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে ফের প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছিল। এ সময় প্রায় ১০ মাস বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন। অবশ্য তিনি তখন কোনো বিচারপতিকে শপথ পড়াননি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি জয়নুল আবেদীন সমকালকে বলেন, সংবিধান সংশোধন করেই প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে রাষ্ট্রপতি পদে আসীন হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছিল। নতুন রাষ্ট্রপতি দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি ফের তার পদে ফিরে আসেন। এখানে সাংবিধানিক শূন্যতা ছিল না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, কোনোভাবেই ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি শপথ পড়াতে পারবেন না। কারণ, সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতিই প্রধান বিচারপতিকে শপথ পড়াবেন। তাই যেহতু ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ নেননি, সে জন্য তারও শপথ পড়ানোর কোনো সুযোগ নেই।
Discussion about this post