২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটকে ‘নবীন বাংলাদেশের জন্য প্রবীণ বাজেট’ বলে মন্তব্য করেছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সংস্থাটি বলেছে, দেশের অর্থনীতির যে ঘনীয়মান সমস্যা, তা মোকাবেলায় কার্যকর পদক্ষেপ নেই এ বাজেটে। বিনিয়োগ, প্রবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতির যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, তা অর্জন নিয়েও সংশয় রয়েছে।
গতকাল রাজধানীর গুলশানের লেকশোর হোটেলে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে এসব পর্যালোচনা তুলে ধরেন সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন। উপস্থিত ছিলেন বিশেষ ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান, গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম ও জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, মূলত দুটো প্রশ্নকে সামনে রেখে সিপিডি এ বাজেটকে পর্যালোচনা করেছে। তা হলো— নতুন চাপ মোকাবেলায় বাজেট কতটা কার্যকর এবং সাম্য ও সমতাভিত্তিক সমাজ গঠনে প্রবৃদ্ধি কতটা সহায়ক?
প্রবৃদ্ধি প্রসঙ্গে দেবপ্রিয় বলেন, ‘আমরা বারবার বলেছি, বিড়াল বড় হতে পারে, বিড়াল ছোট হতে পারে কিন্তু তাকে ইঁদুর ধরতে হবে। অর্থাৎ প্রবৃদ্ধির হার উঁচু হতে পারে, প্রবৃদ্ধির হার নিচু হতে পারে, কিন্তু প্রবৃদ্ধিতে গরিব মানুষের দারিদ্র্য বিমোচন হতে হবে, তাদের বেশি পেতে হবে।
প্রবৃদ্ধি বাড়লেও তা দারিদ্র্য বিমোচন ও বৈষম্য কমাচ্ছে না জানিয়ে তিনি বলেন, যার পুঁজি ও সম্পদ আছে, তার আয় বাড়ানোর সুযোগ আছে। কিন্তু শ্রম ও উদ্যোগের মূল্য নেই। ধনী-গরিবের বৈষম্যও সাম্প্রতিক বছরগুলোয় আগের চেয়ে বেড়েছে। বৈষম্য বৃদ্ধিতে বাংলাদেশ যেন পূর্ব ও পশ্চিম দিকে ভাগ হয়ে গেছে। পূর্ব দিকে আছে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটের মতো ধনী অঞ্চল। আর পশ্চিম দিকে আছে বরিশাল, খুলনা ও রাজশাহীর মতো দরিদ্র অঞ্চল। একদিকে উন্নততর বাংলাদেশ, আরেকদিকে দরিদ্রতর বাংলাদেশ। আমরা দেখছি, সম্পদ, ভোগ এসব ক্ষেত্রে বৈষম্য বেড়েছে।
আয় বৈষম্য কমিয়ে আনা যাচ্ছে না উল্লেখ করে দেবপ্রিয় বলেন, গরিব মানুষের দারিদ্র্য বিমোচন হচ্ছে না। নিম্নআয়ের ৬০ শতাংশ মানুষের আয় কমেছে। অন্যদিকে ৫৭ দশমিক ৪ শতাংশ ধনী মানুষের আয় বেড়েছে। ফলে আয় বৈষম্য আরো প্রকট হচ্ছে। ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগ এখনো স্থবির হয়ে রয়েছে। কর্মসংস্থানে প্রবৃদ্ধির হার এবং গরিবের আয় বৃদ্ধির হার দুর্বল, উৎপাদনশীলতা ও মানবসম্পদের গুণগত মান দুর্বল। এ কারণ বৈষম্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। উন্নয়নের সুবিধা সবাই পাচ্ছে না বিধায় এ বৈষম্য তৈরি হচ্ছে।
অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায় মূল্যস্ফীতির হার ৫ দশমিক ৬ শতাংশ থাকবে বলে উল্লেখ করা হলেও সে বিষয়ে গভীর সংশয় প্রকাশ করে সিপিডি। কারণ বিশ্ব অর্থনীতির যে পরিস্থিতি এবং দেশের ভেতরে যে প্রবণতা বিদ্যমান, তাতে এমন সংশয়ের যথেষ্ট কারণ রয়েছে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।
বাজেটে রাজস্ব আদায়, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বাস্তবায়ন, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, তা নিয়েও সংশয়ের কথা জানিয়েছে সিপিডি। দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য ১ লাখ ১৭ হাজার কোটি টাকার ব্যক্তি বিনিয়োগ এবং প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার সরকারি বিনিয়োগ দরকার। কিন্তু এ ১ লাখ ৪৭ হাজার কোটি টাকার বাড়তি বিনিয়োগ কীভাবে আসবে, তার কোনো দিকনির্দেশনা বাজেটে নেই। ব্যয়ের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার জায়গাগুলোও পরিষ্কার নয়। বাজেটে অর্থায়ন বাড়ানো হচ্ছে। কিন্তু কত খরচ হচ্ছে সেটি জানা যাচ্ছে না।
তিনি আরো বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার রক্ষণশীলভাবে দেখানো হয়েছে। বর্তমান হার ৮২ টাকা ধরা হয়েছে, যদিও তা বর্তমানে প্রায় ৮৩ টাকা। সামনের দিনে আরো বাড়তে পারে। ফলে বিনিময় হারে চাপ সৃষ্টি হতে পারে। তাছাড়া ২৪ শতাংশ হারে আমদানি বাড়ার ফলে বৈদেশিক লেনদেনের ওপর চাপ বাড়ছে। এতে রিজার্ভ ক্ষয় হচ্ছে, যা আগামী চার-পাঁচ বছরের মধ্যে ঋণ নেয়ার ক্ষমতায় চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
ইকুইটিতে হঠাৎ করেই ২২ হাজার ৪৯১ কোটি টাকার বরাদ্দ রাখা হয়েছে কীসের জন্য, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন সিপিডি সম্মাননীয় ফেলো। সেই সঙ্গে এডিপি ও পিপিপির অগ্রগতি নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, এডিপির ৭০ শতাংশই পাঁচটি খাতে বরাদ্দ করা হয়েছে। বাকি ১২টি খাতে ৩০ শতাংশ রাখা হয়েছে। এছাড়া বেশকিছু প্রকল্পে নামমাত্র অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়েছে। ২০ শতাংশ প্রকল্প এক থেকে চারবার সংশোধিত হয়েছে, যা ব্যয় বাড়িয়ে দিচ্ছে। প্রকল্পের গড় আয়ু ৪ দশমিক ৬ বছর। বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের হার দুর্বল হওয়ায় ব্যয় ও সময় বাড়ছে। পিপিপির বিষয়েও কোনো অগ্রগতি বাজেটে নেই।
বাজেট বিশ্লেষণে বাংলাদেশের অর্থনীতির স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি বেশকিছু ভালো-মন্দ দিক চিহ্নিত করেছে সিপিডি। স্বল্পমেয়াদি ভালো দিকের মধ্যে রয়েছে প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা, সরকারি বিনিয়োগের অব্যাহত বৃদ্ধি, রফতানি ও প্রবাসী আয়ের ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, সামাজিক নিরাপত্তাবলয় বৃদ্ধি এবং বৈদেশিক সাহায্যের পরিমাণ বৃদ্ধি। স্বল্পমেয়াদি সমস্যার মধ্যে আছে— রাজস্ব আদায়ে দুর্বলতা, এডিপি বাস্তবায়নে ধীরগতি, কৃষকের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া ও আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়া।
সিপিডি মনে করছে, বাজেটে যে বাড়তি ব্যয়ের লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে, তার বড় অংশ যাবে জনপ্রশাসন ও সুদব্যয় খাতে। সে তুলনায় উন্নয়ন ব্যয় বৃদ্ধির হার একটি জায়গায় আটকে আছে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে জিডিপি অনুপাতে যে ব্যয় করা দরকার, সেটি নেই। এ দুটি খাতে জিডিপির মাত্র ২ শতাংশের নিচে বরাদ্দ রেখে উন্নত দেশ হওয়ার স্বপ্ন বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।
ব্যাংক খাতের করপোরেট করহার কমানোর কঠোর সমালোচনা করেছে সিপিডি। দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ব্যাংক খাতে যে ধরনের নৈরাজ্য চলছে, তা সমাধান না করে এ ধরনের সুবিধা দেয়ায় তারল্য বাড়বে না বলেই আমাদের সন্দেহ। মূলত নির্বাচনে যারা অর্থায়ন করবে, তাদেরকেই এ সুবিধা দেয়া হয়েছে।
বাজেটে ব্যক্তিখাতে করমুক্ত আয়ের সীমা না বাড়ানোয় হতাশা প্রকাশ করে দেবপ্রিয় বলেন, আনুতোষিক ব্যয়ে ৭৫ লাখ টাকা সুবিধা দেয়া হয়েছে। সেটা উচ্চবিত্তের মানুষরা পাবেন। এটা আমাদের কাছে বৈষম্যপূর্ণ মনে হয়েছে। যখন নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তকে সুবিধা দিলাম না, কিন্তু উচ্চবিত্তকে আনুতোষিক ব্যয়ে সুবিধা দিচ্ছি, এটা অর্থনীতির সাম্যনীতিতে ঠিক হলো না। আর পরোক্ষ করের মাধ্যমে রাজস্ব বৃদ্ধির যে পরিকল্পনার কথা অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, তার খড়্গ পড়বে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের ওপর।
তামাকজাত পণ্য রফতানিতে ২৫ শতাংশ শুল্ক তুলে দেয়ার সমালোচনা করেছে সিপিডি। সংস্থাটি মনে করছে, এটা করা হলে দেশে তামাক উৎপাদন বাড়বে, যা সরকারের তামাক উৎপাদন বন্ধ করার নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ব্র্যান্ডের পোশাক ও আসবাবের ওপর এবং আমদানিতে উৎসে ভ্যাট বৃদ্ধির ফলে মানুষের ব্যয় বাড়বে। তবে এ সিদ্ধান্ত অর্থমন্ত্রী ভ্যাটের হার সমন্বয়ের জন্য নিয়েছেন বলে সিপিডি মনে করে।
বাজেট বাস্তবায়নে সিপিডি কিছু সুপারিশও দিয়েছে। সেগুলো হলো— করপোরেট ট্যাক্স আগের অবস্থায় নিয়ে আসা, আবাসনে সারচার্জ ঠিক করা, ব্যক্তি আয়ের ক্ষেত্রে করমুক্ত আয়সীমা ৩ লাখ করা। এছাড়া সঠিক দক্ষতাভিত্তিক বাস্তবায়ন পরিকল্পনার পাশাপাশি ফলাফলভিত্তিক বাজেট পরিবীক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা দরকার বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। উবার, পাঠাওয়ের মতো রাইড সেবা ও ই-কমার্স ব্যবসার ওপর ভ্যাট আরোপের ফলে তরুণদের উদ্যোগ বাধাগ্রস্ত হবে। একই সঙ্গে তা শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ব্যয় বাড়াবে। এখানেও সংস্কার করতে হবে বলে মত দিয়েছে সিপিডি।
Discussion about this post