চট্টগ্রামে কুসুম আকতার (২০) নামে এক গৃহপরিচারিকাকে নির্যাতনের পর হত্যার অভিযোগে কোর্টে মামলা দায়ের করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার দুপুরে চট্টগ্রাম জ্যুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট-৩ শিবলু কুমার দে’র আদালতে মামলাটি দায়ের করা হয়। নির্যাতন করে হত্যার অভিযোগ এনে ৩০২/৩৪ ধারায় সি আর (৩১১/১৮) মামলাটি দায়ের করেন কুসুমের পিতা রমজান আলী। মামলায় গৃহকত্রী স্মৃতি ,তার মা ফেরদৌসী মজুমদার, ও বাবা মোস্তফা মজুমদারকে বিবাদী করা হয়েছে। আদালত শুনানী শেষে এ বিষয়ে কোন নিয়মিত বা অপমৃত্যু মামলা হয়েছে কিনা তা আগামী ১২ নভেম্বরের মধ্যে আদালতকে জানাতে ওসি ফটিকছড়িকে নির্দেশ দিয়েছেন। মামলার বাদী পক্ষের শুনানী করেন এডভোকেট এমরান নাঈম। তিনি বলেন, আদালত শুনানী শেষে মামলাটি আমলে নিয়ে ওসি ফটিকছড়িকে এ বিষয়ে কোন ব্যবস্থা নিয়েছেন কিনা তা জানাতে নির্দেশ দিয়েছেন। মামলার বিবরণ সুত্রে জানা যায়, ফটিকছড়ির কাঞ্চননগর রক্তছড়িকুল এলাকার রমজান আলীর মেয়ে কুসুম আকতার (২০)। গত ৭ মাস আগে দরিদ্র পরিবারের মেয়ে কুসুমকে গৃহপরিচারিকার কাজ করার জন্য ফটিকছড়ির কোর্ট পাড়স্থ ফেরদৌসী মজুমদারের বাসায় রাখা হয়। কুসুমদের গ্রামের জনৈক বালির মা এবং রোকসানার মাধ্যমে কুসুমকে সেখানে দেয়া হয়। এর পর সেখান থেকে কুসুমকে কোথায় নেয়া হয় তা আর কেউ জানেনা। প্রায় দুমাস কোন খবর না পেয়ে কুসুমের বাবা মা ফেরদৌসির বাসায় যান । সেখানে তারা কুসুম কোথায় তা জানতে চান ফেরদৌসির নিকট। তখন তিনি বলেন কুসুমকে তার মেয়ে স্মৃতির বাসায় চট্টগ্রাম শহরে। তখন তারা কুসুমের গৃহকত্রী স্মৃতির মোবাইল নাম্বার সংগ্রহ করে। মামলার বাদী কুসুমের বাবা রমজান আলী জানান, তারা মাঝে মধ্যে কুসুমের সাথে কথা বলতে চাইলেও এক দু মিনিটের বেশী কথা বলতে দিতেননা। এ ছাড়া প্রায়ই সময় কুসুমের মা বাবা ফোন করলে গৃহকত্রী স্মৃতি বলতেন তারা বাইরে আছেন বা ছেলের স্কুলে গেছেন এসব বলে এড়িয়ে যেতেন। তিনি জানান,সর্বশেষ গত ২৩ অক্টোবর ভোর রাতে ফেরদৌসির মেয়ে স্মৃতি তাকে মোবাইল ফোনে বলেন যে আপনার মেয়ে কুসুম স্ট্রোক করেছে আমরা তাকে আপনাদের বাড়ীতে নিয়ে আসতেছি। তখন তিনি প্রশ্ন করে বলেন স্ট্রোক করলে হাসপাতালে না নিয়ে বাড়ীতে কেন আনছেন ? এর কিছুক্ষন পর স্মৃতি এবং ফেরদৌসি একটি এ্যাম্বুলেন্সে করে কুসুমকে নিয়ে তাদের বাড়ীর সামনে যায়। রমজান আলী বলেন তাদের মেয়ে কুসুম যে আর নেই তখনও তারা তা বুঝতে পারেনি। তখন ভোর আনুমানিক ৬ টা । এ্যাম্বুলেন্স থেকে নামানো হয় কুসুমকে । কিন্তু জীবিত নয় মৃত। পুরো বাড়ীতে কান্নার রোল পড়ে যায়। এর পর স্মৃতি এবং ফেরদৌসি বলেন কুসুম স্ট্রোক করে পথে গাড়ীতেই মারা গেছে। এ ছাড়া আগ থেকে সে অসুস্থ ছিল বলে দাবী তাদের। এর পর দাফন কাফনের জন্য ২০ হাজার টাকা দিয়ে তারা চলে আসেন। কুসুমের মা রোকসানা বেগম বলেন, আমরা মেয়ের সাথে কথা বলতে চাইলে তারা কথা বলতে দিতেননা। নানা অজুহাতে এড়িয়ে যেতেন। তিনি বলেন কুসুম মরতে পারেনা । তাকে মেরে ফেলা হয়েছে। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন স্ট্রোক করলে কুসুমকে হাসপাতালে নিয়ে যেত আমরা সেখান থেকে মৃত বা জীবিত নিয়ে আসতাম। স্ট্রোক করেছে ফোনে এমন কথা বলার কিছুক্ষন পরেই কুসুমের লাশ এখানে এসে পৌছায়। তিনি এ ঘটনার সুষ্ঠ বিচার দাবী করেন। এদিকে কুসমের ফুফু ছখিনা বেগম বলেন, কুসুমকে দাফনের আগে তার মরদেহ গোসল করাতে গিয়ে দেখা যায়, তার শরীরের বিভিন্ন অংশে বিশেষ করে পিটের পিছনে দুই বাহুতে পোড়া দাগ এবং সমস্ত শরীর ছ্যাঁকা ছ্যাঁকা । মাথার চুল গুলো উঠে যাচ্ছিল। মরদেহে পঁছন ধরেছে। কুসুমের দাদী সুরুজ্জামান বলেন কুসুমের মরদেহের যে অবস্থা ছিল তাতে মনে হয় কুসুম আরো আগে মারা গেছে। স্থানীয় যুবলীগ নেতা সাইফুল বলেন এটি স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। কুসুমকে নির্যাতনের পর হত্যা করা হয়েছে। তিনি বলেন ফেরদৌসি বিষয়টি আপোষ মিমাংসা করার জন্য ২০ হাজার টাকার প্রস্তাব দেয়। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান রশিদ উদ্দিন চৌধুরী কাতেব বলেন, বিষয়টি শুনার পর আইনি পরামর্শ নেয়ার জন্য কুসুমের পিতাকে ফটিকছড়ি থানায় পাঠানো হয়। এদিকে কুসুমকে গৃহপরিচারিকা হিসেবে কাজ করাতে নেয়া ফেরদৌসি মজুমদার বলেন,কুসুমের একটি কিডনি অকেজো ছিল। এ ছাড়া তার ব্ল্যাড ক্যান্সার ছিল। দীর্ঘদিন অসুস্থ ছিল সে। এর পর হঠাৎ ২৩ তারিখ মারা যায়। কিডনি নষ্ট এবং ব্ল্যাড ক্যান্সার এটা তিনি কিভাবে জানেন এমন প্রশ্নের কোন উত্তর দেননি তিনি। ফেরদৌসির মেয়ে স্মৃতি বলেন, কুসুম দীর্ঘদিন থেকে নানা রোগে আক্রান্ত ছিল। ২২ অক্টোবর তাকে ডাক্তার দেখানো হয়। ২৩ অক্টোবর চমেক হাসপাতালের পরমানু শাখায় কুসুমের আল্ট্রাসনোগ্রাফি করানো হয়। তখন ডাক্তার বলেন কুসুমের অবস্থা ভালনা তাকে বাড়ীতে পাঠিয়ে দেন। স্মৃতি বলেন হাসপাতাল থেকে বাসায় আসার পর কুসুমকে দুধ এবং চা খাওয়ানো হয়। এর পর তার অবস্থার অবনতি হলে রাতে তাকে তার গ্রামের বাড়ীতে নিয়ে যাওয়ার সময় পথেই তার মৃত্যু হয়। তাকে কোন প্রকার নির্যাতন করা হয়নি বলে তিনি দাবী করেন। তবে স্মৃতি এবং তার মা ফেরদৌসির কথাবার্তায় বেশ অসংলগ্নতা পরিলক্ষিত হওয়া গেছে। এদিকে বৃহস্পতিবার দুপুরে চমেক হাসপাতালের পরমানু শাখায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কুসুমকে সেখানে আল্ট্রাসনোগ্রাফি করানো হলেও দৈনিক রোগির রেজিস্ট্রারে কুসুমের নাম নেই। তার নামে দেয়া রিপোর্টে সিরিয়াল নাম্বারও নেই। আল্ট্রাসনোগ্রাফির রিপোর্ট প্রদানকারী ঐ শাখার মুখ্য চিকিৎসক ডাক্তার মো. সাজ্জাদ হোসাইন বলেন, মেয়েটি একজনের রেফারেন্সে এসেছিল। খুব গরীব বলায় আমরা সরকারী নির্ধারিত ফি না নিয়েই আল্ট্রাসনোগ্রাফি করি। তখন তার শরীরে ফুলা ফুলা ভাব এবং বিভিন্ন অংশে পানি উপস্থিতি পরিক্ষিত হয়েছে। তবে কি কারণে তার মৃত্যু হয়েছে সে বিষয়ে তিনি কিছু বলেননি।
Discussion about this post