জনতার কলামঃচিকিৎসা নাগরিকদের মৌলিক অধিকার। আর এই চিকিৎসা পেশায় যারা যুক্ত থাকেন তারাই মহান ও মহৎ ব্যাক্তি হিসেবে জনগণের কাছে প্রতীয়মান হয়। কেননা চিকিৎসার সাথে জড়িয়ে আছে সেবা নামক একটি শব্দ। চিকিৎসা আর দশটি পেশার মত নয়। নয় যে তা স্পষ্ট হয়েছে চিকিৎসার সঙ্গে সেবা যুক্ত হওয়ার মধ্যে দিয়ে। আমাদের দেশে কি বিশ্বমানের হাসপাতাল নির্মাণ সম্ভব নয়? আমাদের দেশে কি বিশ্ব মানের ডাক্তার তৈরী করা সম্ভব নয়? যদি হ্যাঁ হয়, তাহলে সেটা হ্যাঁ কবে হবে। কিভাবে হবে? আগেই বলেছি চিকিৎসা মানুষের অন্যতম মৌলিক অধিকার। অথচ সেই অধিকার নিয়ে নয়-ছয় চলছে বছরের পর বছর ধরে। এই যদি হয় জনসেবার নমুনা তাহলে বড়ই বেমানান। একারণে এখন প্রয়োজন চিকিৎসা সেবার চিকিৎসা করানো। প্রতিদিন সংবাদপত্র খুললেই দেখা যায় দেশের কোথাও না কোথাও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বা ডাক্তারের অবহেলায় ও ভুল চিকিৎসায় রোগি মারা যাওয়ার খবর। সিজার করতে গিয়ে নবজাতকের নাড়ী-ভূড়ি বা অঙ্গ কেটে ফেলার খবর। মেয়াদ উত্তীর্ণ ওষুধ বা ভুল ইনজেকশনের কারণে রোগির মৃত্যুর খবর। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে চিকিৎসকদের নিয়ে যে ঘটনাগুলো ঘটেছে তা দেখলেই বুঝা যায় বাংলাদেশের চিকিৎসাসেবার বেহাল অবস্থার কথা। যে ঘটনাগুলো শুধু সাধারণ মানুষের নয়, উচ্চ আদালতের মাননীয় বিচারপতিদের বিবেককেও নাড়া দিয়েছে। এভাবেই প্রতিদিন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলোতে চিকিৎসা নিতে গিয়ে অবহেলা ও ভুল চিকিৎসায় কেউ লাশ হয়ে ফিরে আসছেন, কেউ পঙ্গু হয়ে যাচ্ছেন ও কেউ অঙ্গ হারাচ্ছেন। আবার একজন অন্তঃসত্ত্বা নারী তার সন্তানটিকে দশ মাস পেটে অনেক কষ্ট সহ্য করে অপেক্ষায় থাকেন সন্তানের মুখ দেখার জন্য। যে সন্তানটিকে ভুল চিকিৎসায় মেরে ফেলা বা অবহেলায় মৃত বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে এসব ঘটনায় ভোক্তভোগীরা যথাযথ বিচার বা ক্ষতিপূরণ পাচ্ছেন এমন সংখ্যাটা খুবই কম। আবার সুযোগ সুবিধাহীন সরকারি হাসপাতালে একশ্রেণির ডাক্তার, নার্স, আয়া-কর্মচারীর চরম দুর্ব্যবহারের সামনে রোগিরা থাকছেন বড়ই অসহায়। আর মানবসেবার নাম করে গড়ে উঠা প্রাইভেট হাসপাতালগুলোরও একই অবস্থা। একটা দেশের চিকিৎসাসেবা এভাবে তলানিতে গিয়ে ঠেকলে আর যা-ই হোক সেই দেশ বিশ্ব সভায় মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। আমরা উন্নয়নশীল দেশ হয়ে উঠছি আর আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা দিনকে দিন কর্দমাক্ত হচ্ছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরতœ মানবতার মা শেখ হাসিনা এই ব্যাপারে কঠিন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন যা এখন এই সময়ের আলোচিত দাবী। ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘চিকিৎসকদের জন্য দু’বছর ইন্টার্নশিপের ব্যবস্থা করতে হবে। এর মধ্যে এক বছর থাকতে হবে উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালে। প্রত্যেক সরকারি হাসপাতালে বায়োমেট্রিক পদ্ধতি চালু করে চিকিৎসকদের হাসপাতালে উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। কেন কোনো এলাকার হাসপাতালে ডাক্তার থাকছেন না? তা সব জেলায় জরিপ চালিয়ে বের করতে হবে। যারা সেবা দেবেন না, তাদের ওএসডি করে রাখতে হবে। কারণ, চিকিৎসকদের রাষ্ট্রীয় সম্মান দেয়া হয়েছে, তাদের অবশ্যই জনগণের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে চাকরি থেকে চলে যেতে হবে তাদের। নার্সরা রোগীর সেবা না করলে চাকুরি থেকে অব্যাহতি নিন।’ প্রধানমন্ত্রীর এই নির্দেশনাকে আমরা অভিনন্দন জানাই। কারণ, সাধারণ মানুষের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিতে কঠোর হওয়ার বিকল্প সরকারের নেই। চিকিৎসকদের গাফেলতি ও গ্রামে উপজেলা পর্যায়ে কর্মক্ষেত্রে উপস্থিত না থেকে জনগণকে চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত করা চিকিৎসকদের তিনি চাকুরীচ্যুত/ওএসডি করার হুমকি দিয়েছেন এবং যথাযথ কর্মস্থলে উপস্থিত থাকার নির্দেশ প্রদান করেছেন। একজন এদেশের নাগরিক হিসেবে তাঁর এই মহতী উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। আমি দীর্ঘদিন চিকিৎসা পেশায় সম্পৃক্ত। একজন প্রাথমিক দন্ত চিকিৎসক হয়ে সাধারণ মানুষের সেবায় নিজেকে ব্রত রেখে পথ চলছি। যুক্ত আছি বৃহত্তর চট্টগ্রাম ডেন্টাল এসোসিয়েশনের সভাপতি পদে। অনেক চড়াই উতরাই পেরিয়ে এই পেশায় ঠিকে আছি। পেশী শক্তির জোরে নয়, হিংসের বশবর্তী হয়ে একইশ্রেণি পেশার লোকজন আমাদের বিরুদ্ধেও বিষেদাগার করে তোলে। আমরা সাবেক মাননীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের সাথে পল্লী দন্ত চিকিৎসক ও পল্লী চিকিৎসকদের সুবিধা অসুবিধা নিয়ে মতবিনিময় করার সুযোগ আমার হয়েছে। মতবিনিময়কালে তিনি বলেছিলেন, শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় এসে মানুষের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে স্বাস্থ্যবান্ধন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। সরকারের স্বাস্থ্যনীতি বাস্তবায়নের ফলে স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ পাচ্ছে জনগণ এবং সকল জনগোষ্ঠী ও শহরের নাগরিকরা স্বাস্থ্যসেবার সমান সুযোগসুবিধা পাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকারের এই কর্মসূচি সফল করতে এবং পরিকল্পিত আধুনিক ডিজিটাল স্বাস্থ্যনীতি বাস্তবায়নে পেশাজীবী চিকিৎসকদের পাশাপাশি ডিপ্লোমা ডেন্টিস্ট, পল্লী চিকিৎসক, পল্লী দন্ত চিকিৎসকদের এগিয়ে আসতে হবে। সরকার ইতিমধ্যে পল্লী চিকিৎসকদের ও ডিপ্লোমা ডেন্টালদের পেশার মান উন্নয়নে প্যারামেডিকেল বোর্ড গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, যা দ্রুত বাস্তবায়ন করা হবে। বর্তমান সরকার দেশের সকল মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এ কর্মসূচির মূল লক্ষ্য হচ্ছে- দেশের সকল মানুষের বিশেষ করে নারী, শিশু ও দরিদ্র জনসাধারণের জন্য যথাযথ মানসম্পন্ন মৌলিক স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা সেবা নিশ্চিত করা। দেশের মোট জনসংখ্যার জন্য রেজিস্টার্ড চিকিৎসক রয়েছেন ৬০ হাজারের মতো। এদের সিংহভাগ থাকেন শহরে। পরিসংখ্যানে দেখা যায় উপজেলা প্রতি চার থেকে ৫ লাখ লোকের জন্য চিকিৎসক আছেন সর্বোচ্চ ১০ জন। এদের এই শূন্যতা পূরণ করে আসছে গ্রাম ডাক্তার, পল্লী চিকিৎসক ও পল্লী দন্ত চিকিৎসকরা। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৮৫ ভাগ মানুষ গ্রামাঞ্চলে বসবাস করে। এই গ্রামাঞ্চলে এমবিবিএস পাশ করা ডাক্তার নেই বললেই চলে, ফলে গ্রাম পর্যায়ের বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীকে স্বাস্থ্যসেবার জন্যে পল্লী চিকিৎসকদের শরণাপন্ন হতে হয়। আমার মতে, দ্রুততম সময়ের মধ্যে তৃণমূল জনগণের কাছে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছাতে পল্লী চিকিৎসকগণ ভূমিকা রাখতে পারে। বর্তমানে অনেক উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তিগণও পল্লী চিকিৎসায়, পল্লী দন্ত চিকিৎসায় নিয়োজিত রয়েছেন, তাদেরকেও প্রয়োজনীয় এবং যথোপযুক্তমানের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে পেশাগত দক্ষতা অর্জন করার মধ্য দিয়ে গ্রামীণ জনপদের বিশাল জনগোষ্ঠীর চিকিৎসা সেবার সাথে সম্পৃক্ত করা যায় তাহলে উপজেলা ও গ্রাম পর্যায়ের মানুষ চিকিৎসাসেবার সুফল ভোগ করবে, যা সন্দেহাতীত। এই পল্লী চিকিৎসক ও পল্লী দন্ত চিকিৎসকদের সরকারিভাবে দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা বা ডিপ্লোমা প্রশিক্ষণের আওতায় এনে চিকিৎসাসেবার সাথে যুক্ত করলে চিকিৎসাসেবার পেছনে সরকার যে ব্যয় করতেছে তার যথাযথ মূল্যায়ন হবে। আর কোনো অবহেলায় রোগীর মৃত্যু ঘটবে না। ঘটবে না চিকিৎসকদের অনুপস্থিতির জন্য রোগীর ভোগান্তি। কারণ চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে মানুষ যুগের পর যুগ নানা ভোগান্তি ও হয়রানির অভিযোগ করে আসছে। এতে করে মানুষের মনের ভিতর চিকিৎসক সমাজের প্রতি ক্ষোভের সঞ্চার হচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে বাংলাদেশের চিকিৎসা ক্ষেত্রে বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। যার ফলে মানুষের ভেতরে জমে থাকা পুঞ্জিভূত ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটার সম্ভাবনা থেকে যাবে। চিকিৎসকরা মানবসেবার মহান ব্রত নিয়ে এ পেশায় আসেন। তাই তাদেরকে সবসময় সাধারণ মানুষের সেবায় নিয়োজিত থাকার মানসিকতা লালন করতে হবে। অবশ্য এই মানসিকতা তাদের রয়েছে বলেও আমরা মনে করি। কারণ, তাদের কারও কারও বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ থাকলেও বেশিরভাগ চিকিৎসকদের ওপর এখনও সাধারণ মানুষের আস্থা উঠে যায়নি। বরং নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও স্বাস্থ্যসেবায় তাদের বেশিরভাগের অবদান প্রশংসনীয়। দেশের চিকিৎসকদের প্রায় সবাই শহরমুখী। অবস্থাদৃষ্টে বলা যায়, তারা সেবা নয় বরং অর্থকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছেন। হাসপাতালের চেয়ে প্রাইভেট চেম্বারই তাদের কাছে বেশি প্রিয়। এক্ষেত্রে কর্মস্থলে চিকিৎসকদের অনুপস্থিতির অভিযোগ আমরা হরহামেশাই শুনতে পাই যা আদৌ কাম্য নয়। এ প্রেক্ষিতে আরেকটি বিষয় হচ্ছে রোগীর প্রতি সহানুভূতিশীল ও সংবেদনশীল হওয়া। চিকিৎসকদের মাঝে এর অভাব প্রকট। চিকিৎসকদের কথায় ও চালচলনে রোগী আশ্বস্ত হবে এমনটি এদেশে সচরাচর আশা করা যায় না। এই কারণে অনেক রোগী চিকিৎসার্থে বিদেশে গমন করে থাকেন। বৃহত্তর স্বার্থে বিষয়গুলো এই পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের ভেবে দেখা প্রয়োজন। চিকিৎসক যদি রোগীর প্রতি আন্তরিক হয়, তারা যদি তাদের আচরণে রোগীদের মন জয় করতে পারে আর শহরমুখী হয়ে প্রাইভেট প্রাকটিস চালানোর যে প্রবণতা তাদের মধ্যে রয়েছে তা বন্ধ করে দিয়ে গ্রাম পর্যায়ে সাধারণ মানুষের চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত থাকার মনমানসিকতায় ব্রতী হোন তাহলে মহান পেশা চিকিৎসা পেশার যে বদনাম রটেছে তা ঘুচবে। সর্বোপরি চিকিৎসক সমাজের আন্তরিকতাই পারে এই পেশার মান রক্ষা করতে, এই দৃঢ়বিশ্বাস রাখি।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট,ডা. মোহাম্মদ জামাল উদ্দিন ।