কামাল হোসেন বেনাপোলঃবুকে তীর বিদ্ধ অবস্থায় উড়ছে ৯টি কবুতর। শরীর থেকে রক্ত ঝরছে। আর পাশেই রক্তের ¯্রােতে বইয়ের বর্ণমালা মুছে যাচ্ছে। তাতে লেখা হয়েছে, ‘আমার বর্ণমালা তুমি ভালো থেকো।’
২০১৪ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় যশোরের বেনাপোল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কোমলমতি ৯ শিশু শিক্ষার্থী নিহত হয়। বেনাপোলে শুক্রবার দিনভর নিহত শিশু শিক্ষার্থীদের স্মরণ করে তাদের ৫ম মৃত্যুবার্ষিকী পালন করা হয়েছে।
সেদিন সকালে মায়ের কোলে বসে সাজুগুজু করে বাবার হাত ধরে পিকনিকের উদ্দেশে গাড়িতে চেপে বসেছিল এসব সোনামণিরা। সেদিন মুজিবনগরে পিকনিক শেষে বাসে বাড়ি ফেরার পথে যশোরের চৌগাছার ঝাউতলা এলাকায় পৌঁছলে তাদের পিকনিকের বাসটি উল্টে ২৫ জন শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হয়। এদের মধ্যে ৬ জন ঘটনাস্থলে মারা যায়। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৫ দিনের মাথায় মারা যায় আরো ৩ শিশু।
মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনায় স্তব্ধ হয়ে যায় এ অঞ্চল। প্রধানমন্ত্রী, শিক্ষা মন্ত্রী শোকবার্তা দেন। মর্মান্তিক দুর্ঘটনাকে
কেন্দ্র করে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিহত শিক্ষার্থীদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে দোয়া মাহফিল, জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন ও ৫ মিনিট নীরবতা পালনের কর্মসূচি ঘোষণা করে। নিহত সেসব ছোট শিশুর রূহের মাগফেরাত কামনায় ১৭ ফেব্রুয়ারি সারা দেশের মতো চৌগাছা, শার্শা ও ঝিকরগাছার সব স্কুল-কলেজ গুলোতে সরকারিভাবে শোক আর দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। এদিনকে বেনাপোল পৌরসভার মেয়র আশরাফুল আলম লিটন বেনাপোল শোক দিবস ঘোষণা করেন। অকালে ঝরে যাওয়া শিশুদের স্মরণে তিনি ওই বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে একটি স্মৃতি স্তম্ভ তৈরি করেন।
ওই স্তম্ভ নিয়ে বেনাপোল পৌর মেয়র আশরাফুল আলম লিটন বলেন, হারিয়ে যাওয়া কোমলমতি শিক্ষার্থীরা ছিল উড়ন্ত পাখির মতো। এরা একদিন বড় হয়ে দেশের সম্পদ হতে পারত। সেদিন তাদের বাঁচানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু আঘাত এত গুরুতর ছিল যে শেষ পর্যন্ত বাঁচানো সম্ভব হয়নি। আমি চাই, যুগ যুগ ধরে মানুষ তাদের স্মরণে রাখুক হারানো কোমলমতি শিশু শিক্ষার্থীদের। তাই তাদের নামে এ ধরনের স্মৃতি স্তম্ভ তৈরি করা হয়েছে।
স্মৃতি স্তম্ভে সকল স্কুল কলেজ ও এমপি শেখ আফিল উদ্দিন সহ সকর রাজনৈতিক সামাজিক ব্যাক্তিত্বরা ফুল দিয়ে বিন¤্র শ্রদ্ধা ভালোবাসা জানান।
তাদের স্মৃতিকে স্মরণ করে বেনাপোল গাজিপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে সকাল ৯ টার সময় যশোর-১ (শার্শা) আসনের এমপি শেখ আফিল উদ্দিন এর নের্তৃত্বে বিশাল শোক র্যালি বের করা হয়। শোক র্যালিতে বেনাপোলের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সহ এ অঞ্চলের সব সামাজিক রাজনৈতিক সংগঠন ও সাধারন জনগন অংশ নেয়। এর পর বেনাপোল বাজার এর প্রধান সড়ক প্রদক্ষিন করে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশুদের স্মরনে আলোচনা ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি শেখ আফিল উদ্দিন এমপি কান্না বিজড়িত কন্ঠে বলেন, চৌগাছা ট্রাজেডির নিহত ৯ টি শিশুর স্মৃতির জন্য তৈরী করা হবে বিশাল একটি ভবন। যে ভবনটির নাম হবে ৯ টি শিক্ষার্থীর নাম অনুসারে । তিনি এসময় অঝোরে নিজে কাঁদলেন ও অপরকে ও কাঁদালেন । দোয়া মাহফিলে শিশুদের আতœার মাগফেরাত কামনা করা হয়।
এদিকে শিশুদের মৃত্যুর পর পাঁচ বছর পার হলেও এখন পর্যন্ত যেন শোক থামেনি নিহতদের পরিবারে। বিশেষ করে আনন্দ উৎসবের দিন এলে তাদের কথা মনে করে কাঁদেন স্বজনরা। আর মৃত্যুবার্ষিকী এলে প্রিয় সন্তানদের ছবি বুকে আঁকড়ে শোকে নিথর হয়ে পড়েন তারা।
ওই দুর্ঘটনায় নিহত মিথিলার মা রেখা বেগম প্রতিদিন একবার হলেও ছুটে যান সন্তানের কবরের পাশে। এ সময় মেয়ের স্মৃতি স্মরণ করে চোখ জলে ভরে যায়। এখানে দাঁড়ালে তিনি যেন বারবার মেয়ের মুখে মা ডাক শুনতে পান। কাঁদতে কাঁদতে বললেন রেখা বেগম। মিথিলা বেনাপোল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৫ম শ্রেণির মেধাবী ছাত্রী এবং বাবা-মায়ের বড় আদরের সন্তান ছিল। শুধু মিথিলার বাবা-মা নয়। ছেলেমেয়ে হারানো সব পরিবারের অবস্থা একই।
এসব সন্তান হারানো বাবা-মায়ের অনেক স্বপ্ন ছিল। তাদের সন্তানরা লেখাপড়া শিখে বড় হয়ে নিজের পরিবার ও দেশ গড়ার দায়িত্ব নেবে। কিন্তু সে স্বপ্নপূরণ হওয়ার আগেই তাদের যেতে হয়েছে না ফেরার দেশে।
বেনাপোল পৌরসভার কাগজপুকুর গ্রামের সৈয়দ আলীর দুই মেয়ে সুরাইয়া ও জেবা। তারাও সেদিনের বাস দুর্ঘটনার শিকার হয়ে মারা যায়। মৃত্যুর আড়াই বছর আগে তারা তাদের মাকে হারিয়েছিল। এর পর থেকে তার বাবা মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ায় শেষ পর্যন্ত দুই মেয়ের আশ্রয় হয় বেনাপোলের ছোটআঁচড়া গ্রামে মামা সামাউলের বাড়িতে। সেখানে থেকেই তারা লেখাপড়া করত। মামা সামাউল বলেন, তারা খুব আদরের ছিল। যখন আমি আমার ও বোনের সন্তানদের জন্য একই কেনাকাটা করতাম। আজ তারা নেই, তার পরও অনেক সময় ভুল করে তাদের জন্যও কেনাকাটা করে ফিরি!
নিহত সাব্বিরের বাবা সেকেন্দার একদিকে ছেলে হারানোর শোক অন্যদিকে বয়সের ভারে অসুস্থ। পেশায় ফুটপাথের মুড়ি ভাজা বিক্রেতা। আশা নিয়ে ছেলেকে পড়ালেখা করাচ্ছিলেন। এক সময় বড় হয়ে সে পরিবারের হাল ধরবে।
ভয়াবহ সেই সড়ক দুর্ঘটনা বেনাপোল, শার্শা ও চৌগাছার মানুষ আজো ভুলতে পারেননি। স্মৃতির পাতায় আজো অমলিন হয়ে আছে। এ দুর্ঘটনায় প্রতিবছর বেনাপোলসহ জেলা জুড়ে নেমে আসে শোকের ছায়া।
আলোচনা ও দোয়া অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন গাজিপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সভাপতি মজনুর রহমান মজনু। বিশেষ অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন, শার্শা উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক নুরুজ্জামান, শার্শা উপজেলা শিক্ষা অফিসার আবুর রব, শার্শা উপজেলা যুবলীগের সভাপতি অহিদুজ্জামান অহিদ, নাভারন ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ ইব্রাহীম খলিল, বেনাপোল ইউনিয়ন চেয়ারম্যান বজলুর রহমান, বেনাপোল পৌর আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক নাসির উদ্দিন, স্বেচ্ছা সেবকলীগের সভাপতি জুলফিকার আলী মন্টু প্রমুখ।
Discussion about this post