ইসরায়েলের প্রবীণ প্রতিরক্ষা প্রতিনিধি অ্যালেক্স ফিশম্যান গত মাসে হিব্রু দৈনিক ইয়াদোথ আহরোনোথে লিখেছেন, “ইসরায়েল একটা উঁচু ঘোড়ায় চড়ে লম্বা পা ফেলে ‘ঐচ্ছিক এক যুদ্ধের’ দিকে এগিয়ে চলেছে। লেবাননের ওই যুদ্ধ এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে।” নিবন্ধে ফিশম্যান আরো বলেন, ‘আদর্শগতভাবে দেখতে গেলে বিষয়টি এমন, আপনি শত্রুকে হুমকি দিতে পারেন যে আপনার ভূখণ্ডে ঢুকে সে আপনার ক্ষতি করতে পারবে না। তবে এ ক্ষেত্রে ইসরায়েল চাইছে, শত্রু তার নিজ ভূখণ্ডে থেকেও তার (ইসরায়েলের) বিরুদ্ধে কিছু করতে পারবে না। করলে ইসরায়েল তার ক্ষতি করবে। আন্তর্জাতিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে দেখতে গেলে এমন হুমকির যৌক্তিকভাবে গ্রহণযোগ্য হওয়ার সুযোগ কম।’
মধ্যপ্রাচ্যের এক বিপজ্জনক সময়ে আমরা বাস করছি। গত সপ্তাহে যে ‘পটপরিবর্তনটি’ হলো, তা এই অঞ্চলটিকে প্রায় যুদ্ধের দিকে নিয়ে গেছে। ইসরায়েলের সবচেয়ে স্পর্শকাতর যুদ্ধবিমানগুলোর একটি এফ১৬আই গত সপ্তাহে বিধ্বস্ত হয়। আমোস হারেল বলেছেন, এ ঘটনার মধ্য দিয়ে ‘রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সিরিয়ায় ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে সংঘর্ষের ইতি টেনেছেন। তাঁর সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছে দুপক্ষই। ইসরায়েলের জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তারা সামরিক অভিযান অব্যাহত রাখার পক্ষেই ছিলেন। পুতিন ও প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর মধ্যে টেলিফোনে কথা হওয়ার কিছুক্ষণ পর সামরিক অভিযান ইতি টানার সিদ্ধান্ত হয়।’
এর পরই আসে দ্বিতীয় ‘পটপরিবর্তন’। মার্টিন ইনডিক এ সম্পর্কে বলেন, ‘স্বর্ণালি অতীতের মতো’ এবার আর ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ছোটেনি। বরং প্রেসিডেন্ট পুতিনকে অনুরোধ জানিয়েছে মধ্যস্থতা করার জন্য। এর অর্থ হচ্ছে, ইসরায়েল মনে করে, প্রেসিডেন্ট পুতিন এখন ‘অপরিহার্য শক্তি’। আর উত্তরের আকাশসীমার কথা যদি বিবেচনায় নেওয়া যায়, তাহলে অবশ্যই তিনি। রোনেন বার্জম্যান নিউ ইয়র্ক টাইমসে লিখেছেন, ‘নিঃসংশয়ে ইসরায়েলের পক্ষে সিরিয়ায় কোনো ব্যবস্থা নেওয়া আর সম্ভব নয়।’ ‘কেউ যদি না জেনে থাকেন তাহলে তাকে অবহিত করি, ওই অঞ্চলে প্রাধান্য বিস্তারকারী শক্তি এখন রাশিয়া।’
ইসরায়েল এখন ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ। তারা ক্ষতির মাত্রা কমাতে চাইছে। ওই অঞ্চলের উত্তরে যে পরিবর্তন ঘটছে তাতে প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বারবারই প্রেসিডেন্ট পুতিনের কাছ থেকে ইরান ও হিজবুল্লাহ যেন সিরিয়া পরিস্থিতি থেকে কৌশলগত কোনো সুবিধা নিতে না পারে সে ব্যাপারে নিশ্চয়তা চাইছেন। কারণ সে ক্ষেত্রে ইসরায়েল ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তবে পুতিনের কাছ থেকে কোনো নিশ্চয়তা মেলেনি। তিনি নেতানিয়াহুকে জানিয়েছেন, ইসরায়েলের নিরাপত্তা স্বার্থের বিষয়টি তিনি বোঝেন, তবে রাশিয়ারও স্বার্থ রয়েছে এবং একই সঙ্গে তিনি এও জানিয়ে দেন যে ইরান রাশিয়ার ‘কৌশলগত অংশীদার’।
বাস্তবতা হলো ইরান বা হিজবুল্লাহর কেউই কার্যকরভাবে ইসরায়েলে নেই (ইরান ও হিজবুল্লাহর পূর্ণ শক্তি সিরিয়ায় নিয়োজিত), তবে নেতানিয়াহু আরো কিছু চান। ভবিষ্যতে সিরিয়া প্রসঙ্গে নিশ্চয়তা পেতে এবং সিরিয়াকে ‘শিয়া’মুক্ত রাখতে নেতানিয়াহু প্রায় প্রতি সপ্তাহেই সিরিয়ায় বোমা হামলা চালান। এই সঙ্গে লেবাননের বিরুদ্ধে যুদ্ধের মতো হুমকি দেওয়াও অব্যাহত রেখেছেন তিনি। কার্যত তিনি প্রেসিডেন্ট পুতিনকে হুমকি দিচ্ছেন—‘আপনি যদি সিরিয়াকে ইরান ও হিজবুল্লাহমুক্ত না রাখতে পারেন, তাহলে দুটি দেশকেই অস্থিতিশীল করে রাখব আমরা।’
রাশিয়া যে বার্তা দিয়েছে সেটি হলো, ‘সিরিয়া ও লেবাননের স্থিতিশীলতাই রাশিয়ার স্বার্থ। আমরা ইসরায়েলের নিরাপত্তা স্বার্থকেও স্বীকৃতি দিই। ইরানের সঙ্গে যুদ্ধ চাইলে সেটি আপনাদের বিষয়। এর মধ্যে রাশিয়া থাকবে না। ভুলে গেলে চলবে না, ইরান আমাদের কৌশলগত অংশীদার এবং তাই-ই থাকবে।’
ইসরায়েলের নিরাপত্তার বিষয়ে রাশিয়ার সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব রয়েছে। তবে ইসরায়েল যদি ইরান ও হিজবুল্লাহর সঙ্গে ইচ্ছা করে যুদ্ধে জড়ায় বা উত্তরের (ইরাকসহ) স্থিতিশীলতাকে নষ্ট করে, তাহলে রাশিয়াকে পাশে পাবে না তারা। প্রেসিডেন্ট পুতিন স্পষ্টভাবেই ইসরায়েলকে ‘ছড়ি’ দেখিয়েছেন—উত্তরের আকাশসীমায় আপনাদের জ্যেষ্ঠত্ব সিরিয়ার বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ফুটা করে দিয়েছে। রাশিয়ার বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ইসরায়েলকে পুরোপুরি পরাজিত করতে পারে। কাজেই ‘দ্বিতীয়বার ভাবুন’।
যদি এর পরও দ্বিধা থাকে, তাহলে রাশিয়ার অ্যারোস্পেস ফোর্সের চিফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল সের্গেই মেশচেরিয়াকভের গত বছরের বিবৃতিটি স্মরণ করা যেতে পারে। তিনি বলেছিলেন, ‘আজ সিরিয়ায় একটি ঐক্যবদ্ধ সমন্বিত বিমানবিধ্বংসী ব্যবস্থা স্থাপন করা হলো। আমরা রাশিয়া ও সিরিয়ার বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় তথ্য ও প্রযুক্তিগত আন্ত সম্পর্ক নিশ্চিত করছি। সিরিয়ার রাডারে আকাশসীমাসংক্রান্ত যা কিছুই ধরা পড়বে সবই রুশ বাহিনী জানতে পারবে।’
এফ১৬ বিধ্বস্ত হওয়ার পর পুতিন ইসরায়েলকে বলেন, ‘সিরিয়াকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা বন্ধ করুন।’ বার্তাটি স্পষ্ট, রাশিয়ার সীমিত নিরাপত্তা নিশ্চয়তা পেয়েছে ইসরায়েল। তবে স্বাধীনভাবে কাজ (হামলার) করার ক্ষমতা হারিয়েছে তারা। কারণ আকাশে প্রাধান্য বিস্তার করতে না পারলে প্রতিবেশী আরব দেশগুলোর ওপর ছড়ি ঘোরানোর ক্ষমতা ইসরায়েলের থাকবে না।
লেখক : অ্যালাস্টায়ার ক্রুক
ব্রিটিশ কূটনীতিক এবং কনফ্লিক্ট ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক
ভাষান্তর : তামান্না মিনহাজ
সূত্র : কালের কণ্ঠ
Discussion about this post