জনতার কলামঃঅসহযোগ আন্দোলন শুরুতে আমরা তেকোটা মুকুটনাইট, করণাখাইন, গৈড়লা নাইখাইন গ্রামের রাজনৈতিক সচেতন ছাত্র-যুবক, চাকুরীজীবীদের প্রত্যেকদিন বিকেলে গৈড়লা ঘোষের হাট জমায়েত এবং এলাকায় এলাকায় মিছিল করা প্রত্যেক দিনের কাজ ছিল।
মানুষকে সংগ্রামী চেতনায় উজ্জীবিত করাই মূল উদ্দেশ্য। যেহেতু আমাদের এলাকা বাম রাজনৈতিক শক্তির ঘাঁটি ছিল। এলাকার মানুষ খুবই রাজনৈতিক সচেতন, প্রতিদিনের সমাবেশ ও মিছিলের কারণে এলাকায় সংগ্রামী চেতনার উম্মেষ ঘটেছিল। তখন এক ব্যক্তির নির্দেশই দেশ চলতো, বঙ্গবন্ধু প্রতিদিন কি নির্দেশ দিচ্ছে তা শুনা এবং নির্দেশ মোতাবেক কাজ করা, এলাকার রাজনৈতিক কর্মীরা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে যথাযথভাবে পালনের জন্য সর্বদা প্রস্তুত থাকতো।
৭ই মার্চ রেসকোর্সে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর মূলত দেশে রাজনৈতিক চরিত্র বদলাতে থাকে, দেশে কি হচ্চে, কি হবে, এ নিয়ে মানুষের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। মানুষ তখন এক দফা, এক দাবীতে ঐক্যবদ্ধ। যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা নির্দেশ দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু, এই নিয়ে রাজনৈতিক কর্মীদের প্রস্তুতি চলছে।
২৫ মার্চ পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর অপারেশন চার্চ লাইট শুরু করার মধ্য দিয়ে দেশে গণহত্যা শুরু করে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী। ঢাকায় রাজারবাগ পুলিশ লাইন, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে ছাত্রবাস আক্রমণ করে শত শত মানুষকে হত্যা করে, এই খবর সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ার পর, দেশের মানুষ দিশেহারা, বঙ্গবন্ধুকে ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী গ্রেপ্তার করার আগে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করে যা ওয়েল্যাস এর মাধ্যমে চট্টগ্রামে আসে যা চট্টগ্রাম বেতার হতে এম.এ. হান্নান সহ কয়েকজন সিনিয়র আওয়ামী লীগ নেতা পাঠ করেন।
স্বাধীনতা ঘোষণা মানুষ আরো উজ্জীবিত হয়ে উঠে, এমনি পরিস্থিতিতে আমাদের এলাকায় আমি গৈড়লা উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে যুবকদের সংগঠিত করার লক্ষ্যে বাঁশের লাটি দিয়ে ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করি। এমনি পরিস্থিতি আমাদের নাইখাইন গ্রামের একজন ইপিআর তার রাইফেল নিয়ে আমাদের ট্রেনিং স্থলে হাজির হন।
আমাদের যুবকেরা ইপির আহমদ ছাফাকে পেয়ে খুবই উৎসাহিত হন। এইভাবে ট্রেনিং চলতে শুরু করে, শহর থেকে আরো কিছু ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী আমাদের সাথে যুক্ত হন, বিশেষ করে চট্টগ্রাম কলেজের বিএনসিসি ট্রেনিং প্রাপ্ত সামশুজ্জামান হীরা ভাই একটি পয়েন্ট ২২ রাইফেল নিয়ে আমাদের সাথে যোগ দেন। এইভাবে ১৯ এপ্রিল পর্যন্ত চলে। এইদিন শুক্রবার বেলা ১১টায় পটিয়া থানার সামনে পাক বাহিনী বিমান হামলা চালায় এবং মেশিনগানের গুলি চালায় এতে অনেক লোক হতাহত হন, একইভাবে দুপুর ২টার সময় আবারো বিমান হামলা হয়। এটার মূল কারণ ছিল চট্টগ্রাম শহর থেকে ইপিআর বাহিনীরলোকেরা পটিয়ায় চলে এসেছিল এবং পটিয়া কলেজে আশ্রয় নিয়েছিল। পরবর্তীতে মেজর জিয়া তাদের সাথে যোগ দেয়। পটিয়া থেকে এনেই জিয়াকে দিয়ে রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতা ঘোষণা পত্র পাঠ করান।
এমনি পরিস্থিতিতে আমরা গৈড়লা স্কুল মাঠের প্রশিক্ষণ বন্ধ করে দিই। তখন জানতে পেরেছি আমাদের কেন্দ্রীয় নেতারা অনেকে ভারতে গমন করেছে। আমার প্রিয় নেতা রাজনৈতিক গুরু কমরেড পূর্ণেন্দু কানুনগোয় এপ্রিলের শেষে দিকে (তারিখ আমার মনে নাই) তেকোটা বড়–য়া পাড়া বৌদ্ধ মন্দিরে এসে আমাকে খবর দিয়ে নিয়ে গেল সেখানে উপস্থিত ছিলেন বন্ধু সুরজিত বড়–য়া, তিনি আমাদের জানালেন ভারতে যেতে হবে নেতারা ভারতে চলে গেছে। সেখানে ট্রেনিং এর ব্যবস্থা হচ্ছে। আমরা দুইজনকে তিনি বলেন তোমরা বোয়ালখালী কধুরখীল গ্রামে বখতেয়ার নোমানীর বাড়ীতে উপস্থিত হবে আমরা একদিন পর বোয়ালখালী বখতেয়ার নোমানীর বাড়ীতে গেলাম তিনি জানালেন কমরেড পূর্ণেন্দু কানুনগোয় রাউজান পাক বাহিনীর দালালদের হাতে ধরা পড়েছে, তাই যাওয়া হলো না।
আমরা দুইদিন গোমদ-ীতে সুজিত বড়–য়া’র এক আত্মীয়ের বাড়ীতে অপেক্ষা করলাম। পরে খবর দিল আবার নিজ বাড়ীতে ফিরে যেতে তাই আমরা আবার নিজ গ্রামে ফিরে এলাম। কৌশলে পূর্ণেন্দু কানুনগো ছাড়া পেয়ে আবার আমাদের গ্রামে আসেন একই বৌদ্ধ মন্দিরে। তখন সন্ধ্যা, আমার নিকট পঞ্চাশটি টাকা হাতে দিয়ে বলেন মিরেশ্বরাই ঠাকুর দীঘির পাড়ে ছাত্র ইউনিয়ন নেতা গিয়াস উদ্দিন আমার জন্য অপেক্ষা করবে আমি যাতে সকাল বেলা মিরেশ্বরাই পৌঁছি। নেতার কথা মত আমি পরদিন সন্ধ্যায় মিলিটারী পোল থেকে সাম্পান যোগে চাক্তাই নামি, সেখানে আমাদের ছাত্র ইউনিয়ন নেতা মো: শাহ আলমের দোকান ছিল দোকানে রাত যাপন করি।
সকালে ঘুম থেকে উঠে জিপিও’র সামনে আসলাম। বুকের পকেটে একটি পাকিস্তানী পতাকা ঝুলাইয়া দিলাম। জিপিও’র সামনে থেকে ধুমের গাড়ী ছাড়তো, আমি ঐ গাড়ীতে উঠে মিরেরশরাই ঠাকুরদীঘির পাড়ে নামিলাম। নামার পর দূর থেকে গিয়াস ভাই আমাকে ডাক দিল, গিয়াস ভাই আমাকে নিয়ে গ্রামের দিকে গেলো, গিয়ে দেখলাম একটি হাট নাম আবুর হাট, আমাদের বালাগাত ভাইয়ের পিতার একটি ঔষধের দোকান ছিল সেখানে আগে থেকেই কয়েকজন বন্ধু উপস্থিত ছিল, ভারত যাওয়ার জন্য, তারা সহ ফেনী নদীর পাড় হয়ে রেল লাইন ধরে ফেনী হয়ে কুমিল্লার দিকে আমরা হাটা শুরু করলাম, এই দলে আমার সাথে মিয়া জাফর আহমদ, রেল শ্রমিক নেতা, মোহাম্মদ শাহ আলম, ফনী ভূষণ দাশ, সুজিত বড়–য়া, তপন দত্ত, গিয়াস ভাই, গোলাম মওলা, কামরুজ্জামান ছিল।
তখন প্রায় সন্ধ্যা, আমরা রেল লাইন ধরে হাটছিলাম, আমরা যখন শশাদী স্টেশনের কাছাকাছি এসে গেলাম তখন একদল লোক দৌড়তেছে জিজ্ঞাস করলাম কি হয়েছে। তারা জানালেন পাকিস্তানী বাহিনী নামছে। তখন আমাদের গাইডার বামদিকে গ্রামের দিকে নিয়ে গেল, তখন রাত প্রায় ৮টা গ্রামের ভেতর একটা বাজার, বাজারে চায়ের দোকানে বসে আমরা পরটা খেয়ে আবার হাটা দিলাম। বাজার থেকেকিছুদূর যাওয়ার পর রাতে আঁধারে একদল লোক আমাদের ঘিরে ফেলে। আমাদের বলে যে, আমরা নাকি হিন্দু ইন্ডিয়া যাওয়ার জন্য যাচ্ছি। আমরা জানালাম আমরা মুসলিম আত্মীয় বাড়ী যাচ্ছি। তাদের হাতে ছিল কিরিচ। তারা আমাদের সব কেড়ে নিল। আমরা গভীর রাতে চৌদ্দগ্রাম ছিউরা কাজী বাড়ী আসলাম। তখন সবাই ঘুম, আমরা রাতে গরুর সাথে গোয়ালঘরে রাত কাটালাম। সকালে কাজী বাড়ী লোকেরা এসেছে।
আমাদের নারিকেল ও রুটি খাওয়ালো, ওখান থেকে একজন গাইডার ঠিক করলাম ১৫/- টাকা দিয়ে তার কাজ হলো আমাদের বেলোনিয়া বর্ডার দেখিয়ে দেয়া। কুমিল্লা চৌদ্দগ্রাম জগত নাথ দীঘি সামান্য দূরে বিলের মাঝ দিয়ে বর্ডারে নিয়ে গেল। সেখানে পাহাড়ের ভেতর একটি সুড়ঙ্গ রাস্তা দেখিয়ে দিল। আমরা সে রাস্তা দিয়ে বেলোনিয়া শহরে আসি। বেলোনিয়ায় সিপিআই এর কার্যালয়ে রাত যাপন করি। পরদিন বাসযোগে আগরতলা ক্রেপ্ট হোস্টেলে আসি। সেখানে দেখা পায় বেগম মতিয়া চৌধুরী, মাওলানা আহমেদুর রহমান আজমী সহ আমাদের অনেক নেতা। সেখান থেকে আমাদের বরদোয়ালী স্কুলে প্রেরণ করলো। সেখানে ১০/১২ দিন অপেক্ষা করার পর আমাদের ইন্টারভিউ হলো। ইন্টারভিউতে জিজ্ঞাস করলো আমরা বাংলাদেশের যে কোন প্রান্তে যুদ্ধ করতে যেতে প্রস্তুত কিনা। যারা হ্যা বলেছে তাদের পৃথক করে আমাদের আর একটি হোস্টেলে পাঠালো। সেই হোস্টেলের দায়িত্বে ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক, সাবেক ছাত্র ইউনিয়ন নেতা ড. মাহাবুবুল হক, সেখানে দুইদিন অপেক্ষা করার পর চৌধুরী হারুনুর রশীদ একদিন ভোরে এসে হাজির হলেন। তিনি আমাদের সবাইকে নিচে নামার নির্দেশ দিলেন। আমরা কাপড় চোপড় নিয়ে নিচে নামলাম। হারুন ভাই সবাইকে লাইন ধরে দাঁড়াতে বলেন আমরা দাঁড়ালাম। তিনি আমাদের হাতে জাতীয় পাতাকা দিয়ে শপথ করালেন। এরপর ভারতীয় সেনাবাহিনীর ২টি গাড়ীতে তুলে আমাদের আগরতলা বিমানবন্দরে নিয়ে গেলেন। সেখানে আগে থেকে অপেক্ষামান ছিল রাশিয়ার বিমান, কার্গো বিমান। সে বিমানে করে একটি সামরিক বিমান ঘাঁটি নামলাম। সেখান থেকে আবার আর্মি ট্রাকে করে নিয়ে গেল ট্রেনিং স্থলে। সেটা আসাম সেনানিবাস এলাকার লুধিয়ানা নামক স্থান। বিশাল মাঠ, পাশে গেরিলাদের ব্যারাক। দেয়া হলো ভারতীয় সেনাবাহিনীর পোশাক। থাকা খাওয়ার রাজকীয় ব্যবস্থা। এখানে ২ মাস ১০ দিন প্রশিক্ষণ নিলাম।
প্রশিক্ষণ নিলাম থ্রি নট থ্রি রাইফেল, স্টেনগান, এস.এম.জি, এলএমজি, এস এল আর, এস কে এস রাইফেল, থার্টি সিক্স হ্যান্ড গ্রেনেড, টু ইঞ্চি মটার, প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভের ব্যবহার, ইমপ্রোভাইজড গ্রেনেড বিস্ফোরণ, ডেমোলিশ, আরসিনিকের বিভিন্ন কৌশল, নাইট রেইড, বেয়োনেট ফাইট ইত্যাদির বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। ভারতের সেনাবাহিনীর ৫৬তম বিগ্রেড এই গেরিলা প্রশিক্ষণ দেন। ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি ছাত্র ইউনিয়নের বিশেষ গেরিলা বাহিনীর প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত সদস্যরা ভারতীয় গোয়েন্দবাহিনীর নেতৃত্বে আসাম থেকে ট্রেন যোগে ত্রিপুরায় আসা হয়। আমাদের ব্যাচক্যাম্প ছিলত্রিপুরার বাইকোরা নামকস্থানে। সেখানে সপ্তাহখানেক অবস্থানের পর ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় সাবরুম বর্ডার দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করি।
আগস্ট মাসে প্রবেশের পর প্রথমে আমাদের সাথে যুদ্ধ হয় পটিয়া কেলিশহর গোপালপাড়া, ইহা ছাড়া ধলঘাট রেল স্টেশন দখল, খৃস্টাখালী রেলওয়ে ব্রীজ ধ্বংস করা, রেল লাইন উপড়ে ফেলা, ধলঘাট স্টেশনের সকল রেল পয়েন্ট উড়িয়ে দেয়া, ইন্দ্রপোল অপারেশন এবং ধ্বংস করে দেয়া, গৈড়লার টেকে দিনভর সম্মুখ যুদ্ধ সে যুদ্ধে পাক বাহিনীর ১৪জন নিহত হওয়া, বিপুল অস্ত্রশস্ত্র দখল করা, ১২০ জন হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করা, পটিয়া থানায় পতাকা উত্তোলন। এটা চট্টগ্রামের বিরাট যুদ্ধ এবং বিজয়। আমাদের লিডার ছিলেন ছাত্রনেতা মো: শাহ আলম ও ডেপুটি লিডার উদয়ন নাগ। আমরা ভারত থেকে ১৯জন গেরিলা বাংলাদেশের প্রবেশে করি। এখানে আসার পর আরো ৩ জন ভারতীয় প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত গেরিলা আমাদের সাথে যোগ দেন।
আমরা স্থানীয়ভাবে প্রশিক্ষণের জন্য করলডেঙ্গা পাহাড়ে ছালতাছড়ি নামক স্থানে প্রশিক্ষণ শিবির স্থাপন করি। আমাদের গেরিলা সামশুজ্জামান হীরার নেতৃত্বে সেই শিবিরে আরো ১৮০ জনকে প্রশিক্ষণ দান করি। আমি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মোতাবেক মিলিশিয়া বাহিনীতে যোগ দিই। পরে এই বাহিনী ভেঙ্গে দেয়া হয় এবং শিক্ষা জীবনে ফিরে যাই।
লেখক : প্রবন্ধকার ও মুক্তিযোদ্ধা।
গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ¦ ফজল আহমদ